ছট্ কথা থেকে ছড়ার উৎপত্তি। ছট্ মানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা। ছড়া মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারময় পদ্য। এটি সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। এটি সাহিত্যের প্রাচীন একটি শাখা। যিনি ছড়া লিখেন তাকে বলা হয় ছড়াকার। ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, ‘ঘুম পাড়ানি ছড়া’ ইত্যাদি ছড়া দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত। প্রাচীনকাল থেকে ইংরেজি ভাষায় ‘ননসেন্স রাইম’ প্রচলিত রয়েছে কারণ ছড়ার প্রধান দাবি ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার, অর্থময়তা নয়।
ছেলেবেলায় ঘুম না আসা দুপুরে মা-নানী-দাদীদের মুখ থেকে ছড়া শোনেন নি এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন। বিশ্বব্যাপী লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ জুড়ে রয়েছে এই ছড়া। তবে সাহিত্যচর্চার মতো সুচিন্তিত, সচেতনভাবে কথা বসানো নয়, শব্দের চলন এখানে বড়ই অনায়াস আর স্বতঃস্ফূর্ত। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই অর্থাৎ যখন মানুষ নিজের ভাব প্রকাশ করতে শিখেছে তখন থেকেই তৈরি হতে থাকে ছড়া। দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে এক যুগ থেকে অন্য যুগে সঞ্চারিত হয়ে যাওয়া এইসব ছড়া রচয়িতার নাম হয়তো অজানা, তবুও তাদের সৃষ্টি রয়ে গেছে আজও। প্রথম দিকে এগুলির কোন লিখিতরূপ না থাকার ফলে লোকের মুখে মুখেই প্রচারিত হয়ে আসছে। মৌখিক প্রচারের ফলে অনেক সময় এগুলির বেশ কিছু কথা বদলও হয়ে যেত; এভাবেই পরিবর্তন, পরিমার্জন কিংবা সংযোজনের মধ্য দিয়ে ছড়াগুলির ক্রমবিবর্তন ঘটেছে।
‘ছড়া’ প্রাচীন যুগে সাহিত্যের মর্যাদা না পেলেও বর্তমানে সে তার প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বা এখনও অনেকেই ছড়াসাহিত্যকে শিশুসাহিত্যেরই একটি শাখা মনে করেন কিংবা সাহিত্যের মূলধারায় ছড়াকে স্বীকৃতি দিতে চান না। কেউ কেউ ছড়াকে কবিতা বলার পাশাপাশি আধুনিক গদ্যকবিতার যুগে এসব মিলযুক্ত কবিতা (অন্ত্যমিল) বা পদ্যের অবস্থানকে হালকা করে দেখেন। তবে পদ্য (কবিতা) এবং ছড়ার মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে- পদ্যের বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট কিন্তু ছড়ায় থাকে রহস্যময়তা।
ছড়ার রয়েছে কমপক্ষে দেড়হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়ার বিকাশ ও উৎকর্ষ আমাদের বারবার চোখে পড়ছে। উল্লেখ, আদিতে সাহিত্য রচিত হতো মুখে মুখে এবং ছড়াই ছিল সাহিত্যের প্রথম শাখা বা সৃষ্টি। সাহিত্য লেখ্যরূপে পাওয়ার পূর্বে ছড়ায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতো। লোকসমাজে ছড়াই ছিল ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। গদ্যসাহিত্যের আগে তাই কেউ কেউ ছড়াকে লৌকিক সাহিত্য বলে বিবেচনা করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন—’ছড়া শিশুদের খেলামেলার কাব্য’। আধুনিক সাহিত্যিকগণ এসব অভিধা মানতে নারাজ। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের মতো ছড়াও সাহিত্যের একটি প্রয়োজনীয় শাখা। এই শাখাটি অন্যান্য শাখার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং এর গ্রহণযোগ্যতা সহজেই ধরা পড়ে।
ছড়া সংগ্রহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য অবদানকে স্মরণে রেখে বলা যায় যে, চর্চা ও সংগ্রহে বহু বাঙালি ব্যক্তিত্ব এ কাজে জড়িয়ে আছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার প্রমুখ। সংকলক হিসাবে নাম করা যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, বিজন বিহারী ভট্টাচার্য, কমল কুমার মজুমদার,ভবতারণ দত্ত প্রমুখ।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে ছড়ার দুটি ধারা দৃষ্ট হয়। একটি ধারা লোকজ সাহিত্য থেকে উৎসারিত আর সমাজসচেতনমূলক বক্তব্যে ঋদ্ধ। দ্বিতীয় ধারাটি সুকুমার রায় প্রবর্তিত হাস্যরসাত্মক ছড়া যা অনেক সময় অর্থহীন বা অসংলগ্ন কথামালার বিন্যাস। ফররুখ আহমদ প্রমুখের হাতে এ ধারাটি সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রথম ধারাটির আধুনিক কালে যাদের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে অন্নদাশঙ্কর রায় তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ এর পর ছড়াচর্চায় সুকুমার রায় ও অন্নদাশঙ্কর রায় — দুই ধারারই প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। এই সমাজমনস্ক ছড়ার ধারাটি ক্রমে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৪৮-১৯৭১ পর্বে পূর্ব পাকিস্তান-এর জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তান-এর শাসক সম্প্রদায়ের আধিপত্য-শোষণ, অত্যাচার-নিপীড়ন, জোর-জুলুম এর বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ-আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে সমাজমনস্ক ছড়ার একটি ভূমিকা ছিল। এ ধারার সার্থক রূপকারদের মধ্যে ছিলেন এখলাসউদ্দিন আহমদ, আল মাহমুদ, রফিকুল হক প্রমুখ।
নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে অনেক মজার ছড়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত ছড়ার মধ্যে কয়েকটির সৃষ্টির পেছনের কথা আমরা জানার চেষ্টা করি।
১.
খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?
ধান ফুরল, পান ফুরল খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।।
ধনিয়া পিঁয়াজ গেছে পচে সর্ষে ক্ষেতে জল।
খরা-বন্যায় শেষ করিল বর্ষ এর ফসল।।
ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি সব শুধু খালি।
ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে শত শত তালি।।
সবার কাছে পরিচিত এই ছড়াটি আসলে একটি ঘুমপাড়ানি ছড়া হলেও এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মারাঠা শক্তির বাংলা আক্রমনের ইতিহাস। ১৭৪০ সালের এপ্রিল মাসে আলিবর্দি খাঁন নিমকহারামী বা বেঈমানী করে প্রভু নবাব সুজাউদ্দিনের ছেলে সরফরাজ খানকে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার নবাব হন। সরফরাজ খাঁর শ্যালক তথা উড়িষ্যার নায়েব নাজিম (উপশাসক) রুস্তম জং আলিবর্দি খাঁর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন।
আলিবর্দি খাঁ বালাসোরের নিকট এক যুদ্ধে রুস্তম জংকে পরাজিত করে, নিজের ভাইপোকে উড়িষ্যার উপশাসক নিয়োগ করেন। রুস্তম জং এরপর নাগপুরের মারাঠা শাসক প্রথম রঘোজি ভোঁসলের সাহায্য প্রার্থনা করেন। মারাঠাদের সাহায্যে রুস্তম জং উড়িষ্যার অধিকার পুনরুদ্ধার করেন। এদিকে মারাঠারা বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ শুরু করে। আলিবর্দি খাঁ পুনরায় উড়িষ্যায় এসে রুস্তমকে পরাজিত করেন। কিন্তু তিনি মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই ভোঁসলে মারাঠা সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতকে অশ্বারোহী বাহিনীর নেতা করে বাংলায় পাঠিয়ে দেন। তারা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে। মারাঠা বর্গিরা বাংলায় ব্যাপক লুণ্ঠন চালাতে থাকে। বর্গি শব্দটা এসেছে একটি ফারসি শব্দ মতান্তরে মারাঠি শব্দ থেকে, যার অর্থ লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদল ।
১৭৪১সালের আগস্ট মাস থেকে ১৭৫১ সালের মে মাস পর্যন্ত মারাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে মারাঠা বর্গিদের দ্বারা ছ’বার বাংলা আক্রমণের ইতিহাস রয়েছে। মারাঠা বর্গিদের এই আক্রমণে বাংলা ও বিহারে প্রায় চার লক্ষ প্রাণ চলে গিয়েছিল এবং প্রভূত ধন-সম্পত্তি লুঠ হয়েছিল। মহিলাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। বাংলার নবাবের সঙ্গে চৌথ আদায়ের চুক্তিতে সন্ধি হলে আক্রমণ বন্ধ হয়। ছড়ার মধ্যে খাজনা আদায় সংক্রান্ত উদ্বেগও স্পষ্ট। পূর্ববঙ্গে বর্গি আক্রমণ হয়নি। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল অবধি এই আক্রমণ চলে। এই সময় বহু মানুষ কলকাতা ও বহু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। সম্ভবত তাঁরাই ছড়াটি পূর্ববঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন।
১৭৫১ সালের মে মাসে আলিবর্দি খাঁ মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করেন। এই সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। এরপর বাংলায় বর্গি হানা বন্ধ হয়। তবে বর্গি আক্রমনের ভয়াবহতা এমনই ছিল যে, বর্গি হানার এই ভয়াবহ স্মৃতি বাংলার ঘুমপাড়ানি গানে পাকাপাকি ভাবে ঠাই পায়।
২.
ইকিড় মিকিড় চামচিকির
চামে কাটা মজুমদার।
ধেয়ে এল দামোদর।
দামোদরের হাঁড়িকুড়ি
দুয়ারে বসে চাল কুড়ি।
চাল কুড়িতে হল বেলা।
ভাত খায়নি দুপুরবেলা।
ভাতে পড়ল মাছি
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোতা
খ্যাঁকশিয়ালের মাথা।।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে সেনাপতি রাজা মানসিংহ শেষ বারের মতো বাংলার বারো ভুঁইঞাদের অন্যতম প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করার জন্য বাংলায় আসলেন । রাজা মানসিংহ জলঙ্গী নদী পেরিয়ে আসতে গিয়ে পড়লেন ঝড়ের কবলে। তখন তাকে সাহায্য করলেন তিনজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের প্রত্যেকেরই পদবি ছিল মজুমদার। তারা হলেন, ভবানন্দ মজুমদার, লক্ষীকান্ত মজুমদার এবং জয়ানন্দ মজুমদার। এঁদের মধ্যে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা, হুগলির কানুনগো দপ্তরের মুহুরি ভবানন্দ মজুমদারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়। ভবানন্দ মানসিংহকে নৌকো দিয়ে নদী পার হতে সাহায্য করেন। নিজের বাড়িতে তাঁকে নিয়ে আসেন ও বিশাল সৈন্যবাহিনীকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ফলে ‘চামচিকির’ কথাটার মানে যে বিশেষ সুবিধের নয় তা অনুধাবন করা কঠিন নয়। ‘চামে কাটা’ মানে যার ‘চামড়া নেই’ বা নির্লজ্জ–বেহায়া। আর ইঙ্গিতটি মানসিংহের সাহায্যকারী মজুমদারের প্রতি। দামোদরের বন্যা তো একটা সময় প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল ।
তাই কোনও নদীর বর্ষায় ফুঁসে ওঠা বা তার ভয়ঙ্কর রূপকে দামোদরের ধেয়ে আসার সাথেই তুলনা করা হত। আর তাই ঝড়বৃষ্টির রাতে ফুঁসে ওঠা ছোট জলঙ্গী নদীকে এখানে ভয়ঙ্কর রূপী দামোদর নদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
মানসিংহ ও তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর খাওয়া-দাওয়ার যে বিপুল আয়োজন তা ভবানন্দ মজুমদার হাসিমুখে করলেও তাঁর পাকশালের কাজের লোকেদের অবস্থার কথাও হয়তো ধরা আছে ছড়ায়। রান্নার ব্যবস্থা করতে তাদের বেলা গড়িয়ে যেত।
আর বাংলার ভুঁইঞাকে আক্রমণ করতে আসা মানসিংহকে যে বাংলার মানুষ নেকনজরে দেখবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক। আর ভারত সম্রাটের সেনাপতিকে যে ভবানন্দ ‘জামাই’ আদরে রেখেছিলেন এটাও তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। যেহেতু ছড়াগুলির উৎপত্তিকালের কোনও লিখিত ইতিহাস নেই, তাই এই বিশ্লেষণগুলি নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। তবে প্রতাপাদিত্য, ভবানন্দ আর মানসিংহের এই সংঘাতের ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
৩.
আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে।
ঢাক মৃদঙ্গ, ঝাঁঝর বাজে।।
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।
ঢুলি গেল সেই কমলাফুলি।।
কমলাফুলির টিয়েটা।
সূয্যিমামার বিয়েটা।।
আয় রঙ্গ হাটে যাই।
এক খিলি পান কিনে খাই।।
পানের ভিতর ফোঁপড়া।
মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া।।
হলুদ বনে কলুদ ফুল।
মামার নামে টগর ফুল।।
সাতগাঁ বা সপ্তগ্রামের বাগদী রাজা, রূপারাজা যখন হরিবর্মার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, তখন হুকুম দিলেন ‘‘সব বাগদী সাজ’’। রূপারাজার ছিল বাগদী ও ডোম সেনা। বাগদী সেনারা লড়াই করে, কিন্তু ডোম সেনারা রাস্তা তৈরি করে, শত্রুর উপর নজর রাখে। একসময় এই ডোম সেনারাই বাংলার পশ্চিম-সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী ছিল। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের, রাজনগরের সামন্তরাজাদের ডোম সেনা ছিল। ‘আগডোম’ মানে অগ্রবর্তী ডোম সৈন্যদল, ‘বাগডোম’ মানে বাগ বা পার্শ্বরক্ষী ডোমসেনা এবং ‘ঘোড়াডোম’ মানে অশ্বারোহী সৈন্যদল। যুদ্ধের দামামা বাজলেই এই ডোমসেনারা গিয়ে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করতেন, রাস্তা বানাতেন আর ঘোড়ায় চেপে দেশের অবস্থা-পরিস্থিতির উপর নজর রাখা শুরু করতেন। এই ডোম জাতি রাঢ় অঞ্চলের সেই সমস্ত তথাকথিত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শরিক, যারা সমাজের উঁচু তলার রাজা, মহারাজা ও সামন্তপ্রভুদের জন্য নির্ভীক বীরের মতো যুদ্ধ করতেন। তাঁদেরই বীরত্বের বলে প্রভুরা থাকতেন নিরাপদে। এই সব প্রভুদের বা রাজাদের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও, ডোমসেনাদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি কোন ইতিহাসের বই বা তাম্রশাসনে। লেখা আছে তুর্কি আক্রমণে বীর মল্ল রাজাদের কথা।
কিন্তু এই বাগদী ও ডোম সেনাদের বীরগাথা লুকিয়ে আছে বাংলার ছোট ছোট ছেলেদের খেলার ছড়ায়, আছে লোকসংগীতে, লোকগাথা ও রাঢ় বাংলার মঙ্গলকাব্যে, যেগুলিকে অনেকেই ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। তখনকার রাজারা বছরের কোন সময়ে যুদ্ধযাত্রা করতেন তার বিবরণও এতে রয়েছে। ছড়া অনুযায়ী, ডোম সৈন্যবাহিনী যখন কমলাপুলি অতিক্রম করছে তখন ‘সুয্যিমামার বিয়ে’ অর্থাৎ সকাল হচ্ছে। ধানের শীষে যখন ফুল ফুটেছে অর্থাৎ বর্ষাশেষে শরৎকাল শুরু হয়েছে সে সময়কে যুদ্ধযাত্রার সময় হিসাবে বলা হয়েছে ।
৪.
তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো !
তার বেলা?
ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ী
পাটের আড়ত্ ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ী !
তার বেলা ?
চায়ের বাগান কয়লাখনি
কলেজ থানা আপিস-ঘর
চেয়ার টেবিল দেয়ালঘড়ি
পিয়ন পুলিশ প্রোফেসর !
তার বেলা ?
যুদ্ধ জাহাজ জঙ্গী মোটর
কামান বিমান অশ্ব উট
ভাগাভগির ভাঙাভাঙির
চলছে যেন হরির-লুট !
তার বেলা ?
তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
বাঙলা ভেঙে ভাগ করো !
তার বেলা?
খুকু ও খোকা ছড়াটি অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত ছড়া। অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪ – ২০০২) একজন স্বনামধন্য বাঙালি কবি ও লেখক। তার জন্ম উড়িষ্যার ঢেঙ্কানলে । তার পূর্বপুরুষের আদি বসতি ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার কোতরং অঞ্চলে (অধুনা উত্তরপাড়া কোতরং )। তার পিতা ঢেঙ্কানল রাজস্টেটের কর্মী নিমাইচরণ রায় এবং তার মাতা কটকের পালিত বংশের কন্যা হেমনলিনী দেবী । ছোটবেলায় ঢেঙ্কানলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় । ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন । তিনি পাটনা বিশ্বিবিদ্যালয় থেকে আই.এ এবং বি.এ পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী হন । এম.এ পড়তে পড়তে দেওয়া আই.সি.এস পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন ।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেন । ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি হন প্রথম সভাপতি এবং আমৃত্যু এই পদে ব্রতী ছিলেন।
অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯৪৭ সালের বোধ হয় ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, খুকু ও খোকা: কবিতাট রচনা করেছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় তখন ময়মনসিংহ জেলা-আদালতের বিচারক। অফিসে যেতে-যেতে, গাড়িতে বসে, ছোট এক টুকরো কাগজে, পেন্সিলে দুই লাইন লিখেন। অফিসে গিয়েও কাজের ফাঁকে-ফাঁকে আরও কয়েক লাইন খসড়া করেন। অফিস থেকে ফিরে চা খেয়ে বাকি অংশ। রাতে ফাইনাল। পরে তিনি নিজেই তা টাইপ করেন। বিখ্যাত এই কবিতার ভাবনা কীভাবে তার মাথায় এলো?
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ।
ময়মনসিংহে তখন বেশ শীত। অন্নদাশঙ্কর রায় সকালে স্নানের আগে নারকেল তেল গায়ে মেখে স্নান করেন। সকালে রোদ ছিলো। নারকেলের তেলের শিশি বারান্দায় দিয়েছিলাম, একটু গরমে যেন গলে যায়। রান্নাঘরে, ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিলেন স্ত্রী লীলা রায় (মার্কিন কন্যা অ্যালিস ভার্জিনিয়া অনফোর্ড)। অন্নদাশঙ্কর রায় হাঁক ছাড়লেন, ‘তেলের শিশি দাও’। কাজের মেয়েটি তখন বাইরে, অন্যকাজে। বারান্দায় খেলছিল নিজের ছোট কন্যা তৃপ্তি রায় (ডাকনাম খুকু)। ওর বয়স প্রায় দুই। ওকে বলা হলো তেলের শিশি বাবাকে দিতে। তেলের শিশি হাতে নিয়ে নাচতে নাচতে (খেলতে খেলতে) যাওয়ার কালে হয়তো তৃপ্তির হাত থেকে পড়ে তা ভেঙে যায়। স্ত্রী লীলা রায় খুব রাগারাগি করলেন, করলেন বকাঝকাও। অন্নদাশঙ্কর রায় মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘সামান্য একটি তেলের শিশি ভাঙল বলে রাগ করছো, এদিকে দেশ ভাঙছে’। তিনি তখন স্নানের ঘরে না গিয়ে, টেবিলে গিয়ে কাগজে কী যেন লিখলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় পরে তার ছোট কন্যা তৃপ্তিকে বলেছিলেন,: তেলের শিশি ভেঙেছিল বলে তুমিই ‘খুকু ও খোকা’ ছড়ার উৎস। অন্নদাশঙ্কর রায় বলতেন, “সব কৃতিত্ব তৃপ্তির, আমি নিমিত্ত মাত্র। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘খুকু ও খোকা’ পাকিস্তান আমলে, পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, ‘খুকু ও খোকা’ ব্যাপক প্রচারিত, পঠিত। গান হিসাবে গীত।
৫. কাজের ছেলে
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল,চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;
ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়, ছিঁড়ে দেবে চুল।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
বাহবা বাহবা – ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ!
দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।
ওই তো ওখানে ঘুড়ি ধরে টানে, ঘোষদের ননী;
আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি!
দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ,
সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!
এসেছি দোকানে-কিনি এইখানে, যত কিছু পাই;
মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!
দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,
চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।
‘কাজের ছেলে’ কবিতার কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার (১৮৬৬-১৯৩৭) শিশু সাহিত্যিক ও কবি। এটি তার মজার ছড়ার একটি। ‘দাদখানি চাল’-কাজের ছেলে কবিতায় একটি কথা এসেছে। দাদখানি শব্দটি হচ্ছে দাউদ খান নামের অপভ্রংশ। কথিত আছে বাংলার সুলতান দাউদ খান (১৫৭৩-১৫৭৬)-এর আমলে বাঙলায় উন্নত মানের দাদখানি চাল উৎপাদন হতো। সুলতানের দরবারে চালটির বেশ কদর ছিল। সুলতান দাউদ খান নিজেও এ চালের ভাত পছন্দ করতেন। তাঁর খাবার টেবিলে আবশ্যিকভাবে এ চালের ভাত থাকতো। ফলে এর নাম হয়ে যায় দাউদ খানি চাল।
উল্লেখ, কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকারের পূর্বপুরুষের ভিটে ছিল বাংলাদেশের যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার ঝাপা ইউনিয়নের ষোলখাদা গ্রামে। এক সময়ে তাদের পূর্বপুরুষের একঘর চলে যায় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে। তার পিতা জয়নগরে বসবাস করলেও তাঁর জন্ম হয় মামারবাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার নেত্রায়। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের অগ্রজ কিংবদন্তি চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকার (১৮৬১-১৯৪৩)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার ডাক্তার নীলরতন সরকার ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ ও শিল্পোক্তা। বহু শিক্ষাসংস্থা, শিল্প ও গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন এবং এগুলি স্থাপনে সহযোগিতা করেছিলেন । কলকাতার বিখ্যাত ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলটি কলেজে রূপান্তরিত হয়ে তার নামে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামাঙ্কিত হয়। তাছাড়া স্যার ডাক্তার নীলরতন সরকারের অন্যতম কন্যা কল্যাণীর ব্যর্থ প্রেমিক, চিরকুমার ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নদীয়ার শহর রুজভেল্ট নগরের (মার্কিন বিমানঘাটি) নতুন নামকরণ করেন কল্যাণী ( ভালবাসার পাত্রী কল্যাণীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেওয়া হলে ধনাঢ্য স্যার নীলরতন সরকার প্রত্যাখান করে বলেছিলেন যে বিধানচন্দ্র রায় ডাক্তারি করে মাসে যা পাবে তাতো কল্যাণীর মাত্র এক দিনের খরচ। সে কারণে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় আর বিয়ে করেন নি। পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় উন্নয়ণের কল্যাণে নতুন শহরকে ‘কল্যাণী’ নামে দ্বিতীয় কলকাতা হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন)।
কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার কলকাতা সিটি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করতে আরম্ভ করেন। এ সময় থেকেই তিনি শিশু সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন এবং শিশুসাহিত্য রচনা আরম্ভ করেন। আজগুবী ছড়া রচনায় তিনি খুব দক্ষ ছিলেন। তার সংকলিত বই হাসি ও খেলা ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় । তিনি মুকুল পত্রিকাটি সম্পাদনাও করেছিলেন।
তিনি ছবির সাহায্যে অক্ষর চেনাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার কবিতাগুলির সাথে সুন্দর ছবি থাকত যা ছোটদের মনে এক কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করত। ছোটদের জন্য লেখা বিদেশী উদ্ভট ছন্দ ও ছড়ার অনুসরণে তিনি হাসি রাশি নামে একটি সচিত্র বই প্রকাশ করেন। এর সাথে সাথেই ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তার সংগৃহিত খুকুমনির ছড়া (১৮৯৯) সংকলন প্রকাশিত হয়। তার রচিত হাসিখুসি (১৮৯৭) বইটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকারের রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৭৮টি।
৬. হাট্টিমাটিম টিম
টাট্টুকে আজ আনতে দিলাম
বাজার থেকে শিম
মনের ভুলে আনল কিনে
মস্ত একটা ডিম।
বলল এটা ফ্রী পেয়েছে
নেয়নি কোনো দাম
ফুটলে বাঘের ছা বেরোবে
করবে ঘরের কাম।
সন্ধ্যা সকাল যখন দেখো
দিচ্ছে ডিমে তা
ডিম ফুটে আজ বের হয়েছে
লম্বা দুটো পা।
উল্টে দিয়ে পানির কলস
উল্টে দিয়ে হাড়ি
আজব দু’পা বেড়ায় ঘুরে
গাঁয়ের যত বাড়ী।
সপ্তা বাদে ডিমের থেকে
বের হলো দুই হাত
কুপি জ্বালায় দিনের শেষে
যখন নামে রাত।
উঠোন ঝাড়ে বাসন মাজে
করে ঘরের কাম
দেখলে সবাই রেগে মরে
বলে এবার থাম।
চোখ না থাকায় এ দুর্গতি
ডিমের কি দোষ ভাই
উঠোন ঝেড়ে ময়লা ধুলোয়
ঘর করে বোঝাই।
বাসন মেজে সামলে রাখে
ময়লা ফেলার ভাঁড়ে
কাণ্ড দেখে টাট্টু বারি
নিজের মাথায় মারে।
শিঙের দেখা মিলল ডিমে
মাস খানেকের মাঝে
কেমনতর ডিম তা নিয়ে
বসল বিচার সাঁঝে।
গাঁয়ের মোড়ল পান চিবিয়ে
বলল বিচার শেষ
এই গাঁয়ে ডিম আর রবে না
তবেই হবে বেশ।
মনের দুঃখে ঘর ছেড়ে ডিম
চললো একা হেঁটে
গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে
ডিম গেল হায় ফেটে।
গাঁয়ের মানুষ একসাথে সব
সবাই ভয়ে হিম
ডিম ফেটে যা বের হলো তা
হাট্টিমাটিম টিম।
হাট্টিমাটিম টিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমাটিম টিম।
হাট্টিমাটিম টিম ছড়ার কবি রোকনুজ্জামান খান (১৯২৫-১৯৯৯)। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক ও সংগঠক ছিলেন। কিন্তু তিনি দাদাভাই নামেই সম্যক পরিচিত ছিলেন। তার জন্ম রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায়। বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের শিশু-কিশোরদের উপযোগী কচিকাঁচার আসর বিভাগের পরিচালক হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রচুর লেখার মধ্যে হাট্টিমাটিম টিম শিশুদের জন্য উপযোগী আরও একটি পাঠকপ্রিয় বাংলা ছড়া। ছড়াটি ৫২ লাইনের। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত। বাঙালি শিশুদের একদম ছোটবেলা থেকেই এই ছড়াটি শোনানো হয়ে থাকে। বেশিরভাগ সময়ই মানুষ মনে করে মূল হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটি চার লাইনের। রোকনুজ্জামান খানের ছড়ার শেষের চার লাইন সুকুমার রায়ের(১৮৮৭-১৯২৩) লেখা। সুকুমার রায়ের ‘রচনা সমগ্র’ বইয়ে এটি আছে। জুড়ে দেয়া হলেও শেষের চার লাইন রুকনুজ্জামান খান নিজের লেখা বলে দাবি করেন নি। হাট্টিমা শব্দটি সুকুমার রায়ের সৃষ্টি। হাট্টিমা= হাট্ টিমা। অর্থ শামুকের হাটা বা হাট্টির হাটা।
৭.
একুশের কবিতা
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে ?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে ?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।
‘একুশের কবিতা’ কবি আল মাহমুদ রচিত। কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতা মীর আবদুর রব এবং মাতা রওশন আরা মীর। বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী কাব্য ‘সোনালী কাবিনে’র স্রষ্টা তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা বেগম আর তাদের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। তিনি ২০১৯ সালে প্রয়াত হয়েছেন।
Nursery Rhymes:
ইংরেজ কবিদের রচিত ছড়া
ইংরেজি ভাষাভাষী শিশুদের এবং আমাদের দেশের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়াদের কিংবা ইংরেজি ভাষা শেখার শুরুতে শিশুদের জন্য যে সকল ছড়া পড়তে দেওয়া হয় সেগুলির মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ছড়াগুলোতো থাকেই। Nursery Rhymes and Nursery Songs এ প্রচুর মজার মজার ছড়া রয়েছে যা শিশুরা গানে গানে এবং কার্টুন দেখে সহজেই শিখে থাকে। ইংরেজ কবিদের রচিত সে সব ছড়া কেবল আমাদের দেশের নয়, বিশ্বব্যাপী শিশুদের বইয়ে দেখা যায়। সে সব ছড়ার একাধিক এবং সেগুলির রচনার পেছনের কিছু কথা এখানে তুলে ধরা হলো।
১. Pussy cat (পুসিক্যাট)
এ ছড়াটি নার্সারী লেভেল বা যে কোনো ইংরেজি ছড়ার বইতে পাওয়া যায়। অনেক মজার ছড়া এটি। ১৬ শতকের দিকে ইংল্যান্ডের একটি ঘটনার উপরে ভিত্তি করে এই ছড়াটি রচিত হয়েছিল। এই ছড়ার সাথে জড়িয়ে রয়েছে ইংল্যান্ডের চিরকুমারী রাণী প্রথম এলিজাবেথের কাহিনী। রাণী প্রথম এলিজাবেথ ১৫৩৩ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের গ্রিনউইচে জন্মগ্রহণ করেন। রাণী প্রথম এলিজাবেথ (সেপ্টেম্বর ৭, ১৫৩৩ – মার্চ ২৪, ১৬০৩) ১৭ই নভেম্বর ১৫৫৮ থেকে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রাণী, ফ্রান্সের রাণী (পদাধিকার অনুসারে) ও আয়ারল্যান্ডের রাণী ছিলেন। ১৬০০ সালে ভারত ও পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে। ৩১ ডিসেম্বর রাণী এলিজাবেথের সনদ বলে উক্ত কোম্পানি উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে সমগ্র পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করে।
রাণী এলিজাবেথের এক কর্মচারির একটি বিড়াল ছিল। রাণীর রাজপ্রাসাদ উইন্ডসর ক্যাসেলের সব জায়গায় সেটি ঘুরে বেড়াতো। ধারণা করা হয়, বসবাসযোগ্য তখনকার বিশ্বের রাজপ্রাসাদগুলোর মধ্যে উইন্ডসর ক্যাসেল ছিল সবচেয়ে বড়। একবার এক অনুষ্ঠানে উইন্ডসর ক্যাসেলে রাণী এলিজাবেথ তাঁর সিংহাসনে বসেছেন। এমন সময় বিড়ালটি সিংহাসনের নিচ দিয়ে লুকিয়ে যাবার কালে তার লেজ রাণীর পা স্পর্শ করে । এতে রাণী ভয় পেয়ে চমকে উঠেন। পরে তিনি লক্ষ্য করে দেখেন এটি ছিল একটি বিড়াল। তা দেখে বিড়ালের মালিক তো ভয় পেয়ে যায়। না জানি রাণীর তরফ থেকে তার জন্য কি শাস্তি অপেক্ষা করছে। তবে মজার কথা হলো রাণী ভয় পেলেও তিনি বিড়ালের মালিকের উপর রাগ করেন নি। কারণ রাণী ছিলেন খুব রসিক ও দয়ালু। সবাই রাণীর দিকে তাকিয়ে। রাণী মজা করে রাজ কর্মচারীদের বললেন,“বিড়ালটি হয়তো বা সিংহাসনকে ইঁদুরের কবল থেকে রক্ষার জন্য পাহারা দিচ্ছে।”
রাণী বিড়ালের মালিককে অভয় দিয়ে বললেন,“তোমার বিড়াল রাজসভায় ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াতে পারবে,তবে শর্ত একটাই-রাজসভাকে ইঁদুরমুক্ত রাখতে হবে।” এই ঘটনাকে উপলক্ষ করে কবি রাসেল পুন্তার(Russell Punter) Pussyi Catনামে ছড়াটি লিখেন। ছড়াটি ১৮০৫ সালে Songs for the Nurseries পুস্তকে প্রকাশিত হয়। গীতিকার ও নার্সারী গান সংগ্রাহক James William Elliot তার National Nursery Rhymes and Nursery Songs (1870) পুস্তকে এটি প্রকাশ করেছিলেন। অনেকে আবার মনে করেন এখানে রাণী যাকে বলা হচ্ছে তিনি নাকি রাজা পঞ্চম জর্জের স্ত্রী ক্যারোলিন অব ব্রুন্সউইক(১৭৬৮-১৮২১)।
Pussy cat, pussy cat, where have you been?
I’ve been down to London to visit the Queen.
Pussy cat, pussy cat, what did you there?
I frightened a little mouse, under her chair.
ছড়াটি শিশুদের মুখস্থ করতে খুব সহজ হয়। সে কারণে সারা বিশ্বে ইংরেজি ছড়ার বইয়ে ছড়াটি দেখা দেয়।
২. Humpty Dumpty (হামটি ডামটি)
হামটি ডামটি ছড়াটিও শিশুদের একটি প্রিয় ছড়া। যদিও বইয়ে হামটি ডামটি ছড়ায় প্রাণির ছবি দেওয়া তবে ছড়াটির কাহিনী কিন্তু একটি কামান নিয়ে। হামটি ডামটি কামানের সাথে ইংরেজদের এক গৃহ যুদ্ধের কাহিনী জড়িয়ে আছে। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টারিয়ান ও রয়্যালিস্টদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল সে যুদ্ধ। পার্লামেন্টারিয়ানরা চায় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার আর রয়্যালিস্টরা চায় রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে। সে গৃহ যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল ১৬৪২ সালে এবং শেষ হয়েছিল ১৬৪৯ সালে। সে যুদ্ধে রাজতন্ত্রীরা কোলচেস্টার দখলের উদ্দেশে একটি বিশাল কামান কাজে লাগিয়েছিল। তাদের সেই বিখ্যাত কামানের নাম ছিল ‘হামটি ডামটি’।
প্রথম চার্লস এই যুদ্ধে রাজতন্ত্রীদের পক্ষে ছিলেন। সে সময়ে একেক এলাকা একেক পক্ষের প্রভাবে ছিল। যদিও কোলচেস্টারে পার্লামেন্টারিয়ানদের প্রভাব ছিল বেশি তবুও রাজতন্ত্রীরা তা দখল করে ফেল। কোলচেস্টার দখলের পরপরই তারা দেয়াল তৈরি করে সে এলাকা সুরক্ষিত দু্র্গে পরিণত করে ফেলে। ওই দেয়ালের লাগোয়া ছিল সেন্ট মেরি চার্চ। রাজতন্ত্রীরা বুদ্ধি করে সেই চার্চ সংলগ্ন দেয়ালের উপরে নিয়ে অনেক কষ্টে সেই বিশাল কামানটি বসায়। একদিন পার্লামেন্টরিয়ানদের এক গোলার আঘাতে দেয়ালটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। হামটি ডামটি কামানটিও দেয়ালের উপর থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। তারা দেওয়ালের অপর স্থানে রাজার ঘোড় সওয়ার বাহিনীর লোকজন( অল দি কিংস হর্সেস অ্যান্ড অল দি কিংস মেন) নিয়ে বিশাল ও ভারি কামানটি তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ফলে পার্লামেন্টারিয়ানদের কাছে রাজতন্ত্রীরা হেরে যায়।
গৃহ যুদ্ধের এই কাহিনী অবলম্বন করেই Mother Goose (Mother Goose is the imaginary author of a collection of French fairy tales and later of English nursery rhymes) এই ছড়াটি রচনা করেন।
Humpty Dumpty
Humpty Dumpty sat on a wall
Humpty Dumpty had a great fall
All the king’s horses and all the king’s men
Couldn’t put Humpty together again
Humpty Dumpty sat on a wall
Humpty Dumpty had a great fall
All the king’s horses and all the king’s men
Couldn’t put Humpty together again
Humpty Dumpty sat on a wall
Humpty Dumpty had a great fall
All the king’s horses and all the king’s men
Couldn’t put Humpty together again
৩ . The Star
টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার ছড়াটি সারা বিশ্ব জুড়েই জনপ্রিয়। কোনো শিশু ইংরেজি ছড়া শিখতে চাইলে প্রথমেই এই ছড়াটি তাকে দেওয়া হয়। মহাকাশ সম্পর্কে কৌতুহলী করতে এবং ছোটদের কল্পনার জগতকে আরও রঙিন করে দিতে ছড়াটির জুড়ি নাই। ইংরেজি এই ছড়ার জন্মভূমি হচ্ছে ইংল্যান্ড। একে বলা হয় দোলনার গানের( Cradle Song or Lullaby বা লাল্যাবি ) ছড়া। লন্ডনের জেন টেলর(১৭৮৩-১৮২৪) কর্তৃক দু’লাইনের শ্লোক ফরমে ছড়াটি The Star শিরোনামে রচিত। অ্যান টেলর (১৭৮২-১৮৬৬)এবং জেন টেলর(১৭৮৩-১৮২৪) দুবোন ১৮০৬ সালে লন্ডন থেকে ছড়াটি Rhymes for the Nursery পুস্তকে The Star শিরোনামে প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশের পরপরই এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ছড়ার বিভিন্ন বইয়ে ছড়াটি ৪ রাইনের থাকলেও মূল ছড়াটি ২০ লাইনের। এতে পঙক্তি রয়েছে পাঁচটি।
Twinkle, twinkle, little star,
How I wonder what you are!
Up above the world so high,
Like a diamond in the sky.
When the blazing sun is gone,
When he nothing shines upon,
Then you show your little light,
Twinkle, twinkle, all the night.
Then the traveler in the dark
Thanks you for your tiny spark,
How could he see where to go,
If you did not twinkle so?
In the dark blue sky you keep,
Often through my curtains peep
For you never shut your eye,
Till the sun is in the sky.
As your bright and tiny spark
Lights the traveler in the dark,
Though I know not what you are,
Twinkle, twinkle, little star.
গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে এমন দেশিবিদেশি ছড়ার মতো অজস্র ছড়া লুকিয়ে আছে। শুধু রাজা-রাণির কথা বা ইতিহাস নয়, ছড়া সাধারণ মানুষের কথাও বলে। আমরা সে সবের সৃষ্টির ইতিহাস বা পেছনের কথা কতটুকুই বা জানি। ছড়া হারিয়ে গেলে ইতিহাস হারিয়ে যাবে। লোকছড়ায় বৃহত্তর জীবন ও সমাজসত্য লুকিয়ে থাকে।
তবে ছড়া তার নিজস্ব নিয়মেই চলবে। কেউ চালালে, না চালালেও। ছড়া সৃষ্টির পেছনের কথা জানা যাক বা না যাক, ছড়া চলুক ছড়ার গতিতে।
-জয়নাল হোসেন
কৃষিবিদ, লেখক ও গবেষক
২৭,১০,২০২২