দু’শ বছরের স্বাধীন বাংলার ইতিহাস ভারত উপ-মহাদেশের মুসলিম শাসনামলে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈচিত্র্যময় অধ্যায় হিসেবে পরিগনিত। বাংলায় ১৪৯৩-১৫৩৮ সাল ছিল হোসেনশাহী যুগ। সে স্বাভাবিক কারণে শাসন ব্যবস্থা, সমাজ জীবন, সাহিত্য, শিল্পকলা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, দর্শন ও ধর্মীয় চেতনার চরম বিকাশ ঘটে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখ আছে, মুসলমানদের আগমনের ফলে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা হয়।
সুখময় মুখোপাধ্যায় স্বজ্ঞানে এবং বিদ্বেষমুলকভাবে বলেন যে, হোসেন শাহ বিদ্যোৎসাহী ছিলেন না এবং হিন্দু সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন নি। অথচ এটি সর্বজনবিদিত ও সর্ব সম্মত তথ্য এই যে, হোসেন শাহী আমলে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণ যুগ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। সাহিত্য চর্চার প্রতি উদার মনোভাব শুধুমাত্র আরবি এবং ফারসি ভাষায় লিখিত গ্রন্থাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং মাত্রাধিকভাবে তার সময়ে রচিত মহামূল্যবান গ্রন্থ ও রচনাবলি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বাংলা লেখকদের মধ্যে মালাধর বসু, বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত এবং যশোরাজ খান শ্রদ্ধাভরে তার হোসেন শাহ গুণকীর্তন করেছেন। মূলত বাংলা ভাষার প্রতি তার অসীম আগ্রহ ও মোহ ছিল। প্রভাবান্বিত হয়ে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খান কবীন্দ্র পরমেশ্বর কে “মহা ভারত” রচনায় উৎসাহ দেন। পরমেশ্বর সম্ভবত বাংলা ভাষা “মহা ভারতের” সর্বপ্রথম অনুবাদক। পক্ষপাতদুষ্ট ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায় এ সমস্ত কথা স্বীকার করতে চান না, বরং তিনি কটুক্তি করেন।
ইংরেজ শাসনকালে বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, অচিন্ত্যকুমার, সেনগুপ্ত, নবগোপাল দাশ, দেবেনচন্দ্র দাশ প্রভৃতি বাঙালী সাহিত্যিকেরা সরকারি কর্মচারী ছিলেন। এ থেকে প্রমাণ হয় না যে ইংরেজ সরকার বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সুখময় বাবু ইংরেজ আমলের কবি-সাহিত্যিকদের সাথে তুলনা না করে মুঘল দরবারে আকবরের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তুলনা করতে পারতেন। ফৈজি, আবুল ফজল, বাদউনী যে কবিতা, সাহিত্য ও ইতিহাস রচনা করেছেন তা কি আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় হয় নি? এমন কি হোসেন শাহ যে পন্ডিতদের সম্মান করতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় আতিরস সংবলিত লৌকিক প্রণয় কাহিনীতে; যা যশোরাজ খান ও কবিরঞ্জন রচনা করেন। এ দু’জন কবি হোসেন শাহ কে সন্তুষ্ট করার জন্য এ ধরণের যৌনতা বিষয়ক রচনায় ব্রতী হন।
সুলতান হোসেনশাহের উদার মনোভাব, মমত্ত্ব, পরোপকারী, পরধর্ম সহিষ্ণুতার প্রমাণ এই যে, তিনি চৈতন্যকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তার প্রতি কোন যেন অসদাচরণ করা না হয় তার জন্য কর্মচারীদের নির্দেশ দেন। হোসেন শাহ তার প্রিয় দুই কর্মচারী রূপ ও সনাতন কে চৈতন্যের নিকট পাঠান তার কুশল জিজ্ঞাসার জন্য। রূপ ও মনাতন চৈতন্য প্রেমে পড়ে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এতে হোসেন শাহ কোন বাধা দেন নি।
“ঐছে চলি আইলা প্রভু রামকেলি গ্রাম
গৌড়ের নিকট গ্রাম অনুপম
তাহা নৃত্য করে প্রভু প্রেমে অচেতন
কোটি কোটি লোক আইল দেখিতে চরণ
গৌড়েশ্বর যবন রাজা প্রভাব শুনিয়া
কহিতে লাগিলা কিছু বিস্মিত হইয়া।
সুতরাং সুলতান হোসেন শাহের রাজত্বকাল কে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলা যায় এবং তার সাথে সাথে শিল্পকলার যে অগ্রগতি হয়, বিশেষ করে স্থাপত্য শিল্পের তা তুলনা বিহীন।
লেখক পরিচিতি
ইউসুফ আরমান
দক্ষিণ সাহিত্যিকাপল্লী
বিজিবি স্কুল সংলগ্ন রোড়
০৬নং ওয়ার্ড, পৌরসভা
কক্সবাজার সদর।
০১৮১৫-৮০৪৩৮৮
yousufarmancox@gmail.com