বহুমূখী সমস্যায় জর্জরিত মায়ানমার সেনাবাহিনী পূর্ণ শক্তি নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে আরকান তথা রাখাইন রাজ্যে।প্রতিপক্ষ আরকান আর্মি। কিন্তু গায়ে পড়ে বাংলাদেশকে এ যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছে কেন মায়ানমার? এদিকে যুদ্ধ বিমান,হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হচ্ছে গোলা। আর ব্যাপক বেসামারিক লোক ও শিক্ষার্থী কে গুলি ও গোলার আঘাতে হত্যা করছে তারা । চলছে অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট।
এর তীব্রতা এসে পড়ছে বাংলাদেশ সীমান্তে।খোঁজ নিয়ে জানাগেছে গত দুই মাসে মায়ানমার যুদ্ধ বিমান পাঁচ বার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লংঘন করলে ও কোন দুঃখ প্রকাশ নেই মায়ানমারের।প্রতিনিয়ত ঘটছে হতাহতের ঘটনা। নাফ নদীর মোহনা শাহপরীর দ্বীপ থেকে রাঙ্গামাটিস্থ ভারতের মিজোরাম পর্যন্ত মায়ানমার সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বাংলাদেশ।
এদিকে টেকনাফ থেকে নাইক্ষ্যছড়ি পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার সীমানায় কৃষিকাজ ও ক্ষেত খামার এখন পুরোপুরি বন্ধ।ফলে হত দরিদ্র মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে।সীমান্তের ঝুঁকি পূর্ণ এলাকায় বিজিবি কাউকে যেতে দিচ্ছেনা। নাফ নদীতে জাল ফেলতে পারছেনা জেলেরা দীর্ঘদিন ধরে।
সচেতন নাগরিক সমাজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন
এমনিতেই মিয়ানমারের কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এখন হিমশিম খাচ্ছে, তারপরও সীমান্ত গোলাবর্ষণ করে বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবন অনিরাপদ করে তোলা, কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা দেশের ভেতরে নানা সংকটের মধ্যে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সমীকরণে ওই জুলুমবাজ সরকারও কোনো না কোনো বিশ্ব শক্তির সমর্থন পেয়ে একেবারেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনো প্রতিবাদ ও নিন্দাই তারা গায়ে মাখে না। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের এক কুদৃষ্টান্ত হয়ে আছে দেশটি।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে দেশের জনগণকে নির্বিচারে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘ।
গত শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আরো বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক যেন বিদেশি মুদ্রা আয় করতে না পারে সেজন্য লক্ষ্য স্থির করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ও তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি সুপারিশ জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর।
এ দিকে নো ম্যানস ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গারা জান মালের নিরাপত্তা চেযে জাতিসংঘে আবেদন করেছেন।
সরকারি সেনা ও জান্তা এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে কিছুদিন ধরেই তুমুল লড়াই চলছে মিয়ানমারের ভেতরে। দুই বাহিনীরই এখন দিশেহারা অবস্থা।
তাদের নিক্ষিপ্ত গোলা এসে বারবার পড়ছে বাংলাদেশের ভেতরে। গত এক মাসে কমপক্ষে পাঁচবার বাংলাদেশের সীমানায় এসে পড়েছে ওপার থেকে নিক্ষিপ্ত গোলা। তবে শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে মাইন বিস্ফোরণ ও মর্টার শেলের আঘাতে একজন নিহত আর সাতজন মানুষ আহত হওয়া ছিল গত পাঁচ বছরের মধ্যে ভয়াবহ এক ঘটনা। আর সে কারণে তুমব্রু শূন্যরেখার আশ্রিত সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গার অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে ছোট ছোট দলে। আরও অনেকে তৈরি হচ্ছে পালাতে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে গত রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) ১২টি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছেন মিয়ানমারের সেনারা। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে এ মর্টার শেলগুলো এসে পড়ে। বিকট আওয়াজে বারবার কেঁপে ওঠে সীমান্তে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা শিবির এবং ঘুমধুম এলাকায় বাংলাদেশের গ্রামগুলো।
গত মঙ্গলবার থেকে উখিয়া সীমান্তের পালংখালীর আনজুম পাড়া নলবুনিয়া, বালু খালী,রহমতেরবিল এলাকাও কেঁপে উঠে গোলাবর্ষণের বিকট শব্দে।
এ ছাড়া সারা গত শনিবার ও সীমান্তের ওপারের মিয়ানমারের ভেতর থেকেও এসেছে গোলাগুলির শব্দ। সে দেশের একটি যুদ্ধবিমান তুমব্রু শূন্যরেখা ঘেঁষে মিয়ানমার আকাশে উড়তে দেখে গ্রামটির বাসিন্দারা। সীমান্তে এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং চয়ে মোয়েকে গত রোববার দুপুরে ডেকে কড়াভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, ‘নিজেদের সীমানার ভেতরে যা করো, সেটা তোমাদের নিজেদের ব্যাপার। এপারে গোলাগুলি যাতে আর না আসে, জানমালের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে একটু নজর রেখো।’ এই নিয়ে গত এক মাসে চতুর্থবারের মতো তলবে হাজির হতে হলো মিয়ানমার দূতকে। তবে সীমান্তের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের বিরক্তির প্রকাশ ঘটাতে এবার তাঁকে চা-কফি বা কোনো কিছুতেই আপ্যায়ন করা হয়নি।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের জল ও স্থলসীমান্ত ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়িতে স্থলসীমানা আছে ৯১ কিলোমিটার। নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু বাজারের ব্যবসায়ী বদি আলম, গ্রাম পুলিশ আবদুল জাব্বার, রোহিঙ্গা আবদুচ্ছালাম এবং দক্ষিণ চাকঢালার ফরিদ আলম ও জাফর আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, সীমান্তে ভয়ানক এই উত্তেজনায় তটস্থ তুমব্রু, কোনারপাড়া, বাইশফাঁড়ি, তুমব্রু হেডম্যানপাড়া, ভাজাবুনিয়া, মধ্যমপাড়া, উত্তরপাড়া, বাজারপাড়া এবং গর্জনবুনিয়া সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ চাকঢালা, সাপমারা ঝিরি ও জামছড়ি গ্রামের মানুষজন।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়িতে গত রোববার ‘সীমান্ত পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধিদের করণীয়’ শীর্ষক এক জরুরি সভা ডাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস। ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, সীমান্তে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে তিন শ পরিবারের প্রায় দেড় হাজার লোককে প্রয়োজন হলে সরিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে প্রশাসন।
তবে বৈঠকে জানানো হয় ঘুমধুম ইউনিয়নে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। এ ছাড়া স্কুলগুলোতেও থাকার কোনো পরিবেশ নেই। এ পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। বৈঠকে জনপ্রতিনিধিরা জানান, গোলাগুলির বিকট আওয়াজে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ভয়ে পড়ালেখা পর্যন্ত করতে পারছে না।
তাঁরা আরও জানান, সীমানা ঘেঁষে এ গোলাগুলিতে সীমান্ত সড়কের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে ১৫-২০ দিন ধরে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আবারও বলেন, মিয়ানমার থেকে একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে আর ঢুকতে দেওয়া হবে। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
ওদিকে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে দেশের জনগণকে নির্বিচারে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘ।
গত শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আরো বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক যেন বিদেশি মুদ্রা আয় করতে না পারে সেজন্য লক্ষ্য স্থির করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ও তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি সুপারিশ জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর।
মায়ানমার জান্তা সরকার একদিকে
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে লড়াই করছে আর সামরিক শাসনবিরোধী হাজার হাজার লোককে কারাগারে নিক্ষেপ করছে।
রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও প্রতিবেশিদের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য অব্যাহত আছে এবং বেশ কয়েকটি দেশ জান্তাকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। চীন শত্রুতা শেষ করার আহ্বান জানালেও রাশিয়া দেশটির জেনারেলদের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক মিত্র হয়ে আছে এবং অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের জান্তা প্রধানকে তিনটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বরণ করেছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারকে যুদ্ধবিমান ও সাঁজোয়া যান দিয়েছে রাশিয়া, চীন যুদ্ধ ও পরিবহন বিমান সরবরাহ করেছে, সার্বিয়া রকেট ও গুলি দিয়েছে এবং ভারত একটি দূরবর্তী বিমান প্রতিরক্ষা স্টেশন তৈরিতে সহায়তা করেছে।
মিয়ানমারকে শান্তির প্রতি নত হতে বাধ্য করা তখনই সম্ভব হবে, যখন কোনো দেশ কোনো অজুহাতেই মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরাচারী শাসকদের সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করবে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব?
এ দিকে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের রাষ্ট্র দূত কে তলব করে মায়ানমার জান্তা সরকার।ডেকে বলা হয় আরকান আর্মি ও আরসার ঘাটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কী না জানতে চেয়েছেন।এ ভাবে জানতে চাওয়ারপেছনে মারাত্মক অন্যকোন কূ মতলব রয়েছে বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির দায় ভার কোনমতে বাংলাদেশের উপর ছাপনো গেলে আন্তর্জাতিক পশ্চিমা বিশ্বের মনোভাবে ফাটল ধরিয়ে বাড়তি সুযোগ গ্রহনের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার।