১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল কি হবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার পূর্ব থেকে আঁচ করতে পারেনি। কিন্তু ফলাফল যা দাঁড়ালো তাতে তাদের চোখ তো রীতিমত ছানাবড়া। তারা ভেবেছিল পূর্ববঙ্গে ভোট ভাগাভাগি হবে এবং আওয়ামী লীগ বিরোধীদের সাথে যোগসাজশ করে পশ্চিম পাকিস্তানীরাই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু তাদের আশা অপূর্ণই থেকে গেল। তারা দেখল শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীতো হবেনই, সেনাবাহিনীর ক্ষমতাও খর্ব করে দেবেন। তাই নির্বাচনের ওই ফলাফল নাকচ করে দেয়ার জন্য তারা গণহত্যার পথে হাঁটে। ১৯৫৪-এ চালু করেছিল গভর্ণরের শাসন এবার শুরু করল সরাসরি হত্যাকাণ্ড। তাদের ভাষায় মিলিটারি একশন।
ফলে যে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একদিন যে পাকিস্তানের সৃষ্টির বীজ রোপিত হয়েছিল, সেই ঢাকাতেই পাকিস্তানের পতন ঘটল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, পাকিস্তানের সূচনা হয়েছিল ঢাকাতে পতনও এই শহরে। সূচনা ১৯০৬ সালে, যখন সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। পতন ১৯৭১ সালেÑ যখন পাকিস্তানকে ‘রক্ষাকারী’ সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। কেবল ঢাকাতেই যে পাকিস্তানের সূচনা ও পতন তা নয়। ঢাকা শহরের একই এলাকাতেই ওই দুটি পরস্পর বিরোধী ঘটনা ঘটল। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা ঘটে বিশ^বিদ্যালয় এলাকাতেই। এখন যেখানে মধুর কেন্টিন সেখানকার একটি ঘরেই। ওটি ছিল তখন ঢাকার নবাবদের বাগান বাড়ির অংশ। আর পতন তারই কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, এক সময়ে ঘোড়দৌঁড়ের মাঠ থাকায় এটির অপর নাম রেসকোর্স ময়দান।
মূলত: এক কঠিন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৯৭১। সবাই আশা করেছিল ইয়াহিয়া পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া অকস্মাৎ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পর গোটা বাংলাদেশ অচল হয়ে যায়। এ সময় (১ মার্চ ১৯৭১) হোটেল পূর্বানীতে চলছিল আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পর্টির বৈঠক। দুপুর ১.০৫ মিনিটের সময় বেতারে আকস্মিক জনৈক ঘোষকের কণ্ঠে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে জারী করা হয় এক ঘোষণা। ওই ঘোষণায় বলা হয়, “পকিস্তান আজ চরম ভয়াবহ এবং রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদান না করার সংকল্প প্রকাশ করেছে। এছাড়া ভারতের পরিকল্পিত উত্তেজনাকর পরিস্থিতি জাতির সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। আমি জাতীয় পরিষদের আহ্বান পরবর্তী কোনো তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম।”
অধিবেশন স্থগিত করার খবরটি বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফুটন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে যেন লাভা উদ্গীরণ শুরু হয়ে যায় দেশ জুড়ে। জনতা লাটিসোটা নিয়ে নেমে আসে রাস্তায়। অল্পক্ষণের মধ্যে বাঁশের লাটি, লোহার রড, হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে হোটেল পূর্বনীতে। হিংসাত্মক ঘটনার আশংকায় বঙ্গবন্ধু সবাইকে শান্ত করেন। বিকেল ৪টার দিকে হোটেল পূর্বানীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে ২ ও ৩ মার্চ যথাক্রমে ঢাকায় ও সারাদেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হবে বলে তিনি জানান। কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ ব্যাপক হামলা চালায়। সেনাবাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করলে জনতার সাথে সংঘর্ষ হয়। গুলিতে নিহত হয় কয়েকজন। এরপর বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেদিনের প্রচারিত প্রথম নির্দেশ পত্রে ৩ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। বস্তুত সেদিন হতেই পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে।
এ সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে অকাতরে মানুষ মরতে থাকলেও সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’, ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে উজ্জীবিত বাঙালী আর পেছনে তাকাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে পাক জান্তার উপর চাপ সৃষ্টি করতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। খাদিম হোসেন রাজা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, ১ মার্চ থেকে বাংলাদেশে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সর্বস্তরের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের উপর আনুগত্য প্রকাশ করে। এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও তাঁর সাথে দেখা করে দিক নির্দেশনা চান। প্রকৃত অবস্থা হলো, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সব সংস্থার কর্মকর্তারা শেখ মুজিবের সদর দপ্তরে [বাসভবনে] যান তাঁর দিক নির্দেশনা নিতে। এমন কি পুলিশ প্রধান সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়া বন্ধ করে তাঁর কাছে যান। পাকিস্তান ন্যাশনাল পার্টির নেতা ওয়ালী খান সে সময় ঢাকায় এসেছিলেন। পাকিস্তান ফিরে গিয়ে শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন: ‘মহাত্মা গান্ধী আজ বেঁচে থাকলে বিস্মিত হতেন। সে সময় শেখ মুজিব ছিলেন বিস্ময়। বিদেশী সাংবাদিক যারাই পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন বঙ্গভবন নয়, সচিবালয় নয়, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের দোতলা বাড়িটি থেকে শেখ মুজিব দেশ পরিচালনা করছেন। মহল্লার অপরিচিত কোনো রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে হাইকোর্টের বিচারকরা পর্যন্ত সেখানে এসে তাঁর পরামর্শ নিচ্ছেন।’
এদিকে ছাত্ররা ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন এবং পরদিন ৩ মার্চ পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। এরপর এলো ঐতিহাসিক ৭ মাচ। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীনতা অর্জন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সমস্ত নির্দেশনা আসে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে রেসকোর্সের ময়দানে।
শুধু ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’- এই বাক্যটি ছাড়া আর সব ছিল কালজয়ী ওই ভাষণে। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে সেদিন বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্ভিক, আবগে বঞ্চিত। লক্ষ লক্ষ মানুষের ওই জনসমুদ্রে আবেগ প্রশমিত করে প্রতিটি শব্দ প্রয়োগে ছিলেন সংযত, সংহত এবং ঐশী প্রেরণায় পরিকল্পিত। অলিখিত এই ভাষণটি স্রোতাদের কাছে ছিল একটি ছন্দবদ্ধ কবিতা। ছিল ক্ষুব্ধ ব্যাঘ্রের গর্জন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি বাক্য উচ্চারণের সাথে ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠেছে রেসকোর্সে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ বিদ্বগ্ধ শ্রোতা। এই ভাষণ একান-ওকান হয়ে নিমিষে ছড়িয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গে তরঙ্গে, বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তরে। আর গর্জে উঠেছে আবাল বৃদ্ধ বণিতা। অতপর সময়ের ব্যবধানে এই ভাষণ হয়ে উঠে পৃথিবীর সেরা কয়েকটি ভাষণের একটি। তাইতো সংকটে, সংগ্রামেÑ বাঙালী বারবার ফিরে যায় ৭ মার্চের ভাষণে- আর এতে সে পায় অমোঘ শক্তি, পায় প্রেরণা।
দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, ৭ মার্চ যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসেন, তাহলে ইয়াহিয়া পাকিস্তান ভাঙ্গার দায় তাঁর উপর চাপিয়ে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করবে। অন্যদিকে স্বধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অজুহাতে তৎক্ষণাৎ চরম ধ্বংসযজ্ঞ মেতে উঠবে তারা। কারণ তখন পাক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ম্যাসাকার করার জন্য অজুহাত খোঁজছিল। যার বর্ণনা পাওয়া যায়, ঢাকায় কর্মরত পাকিস্তানী মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার বয়ানে। খাদিম তার এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যদি শেখ মুজিব দেশের অখণ্ডতার উপর কোনো আঘাত হানেন বা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসেন, আমি আমার অধীনে ন্যস্ত সকল শক্তি নিয়ে সাথে সাথে আমার দায়িত্ব পালনে নেমে পড়বো কোনো ইতস্তত না করে। মিটিং ভঙ্গ করার জন্য আমি আমার বাহিনীকে সাথে সাথে মার্চ করিয়ে দিবো সেদিকে এবং যদি দরকার হয় ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হবে।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু জান্তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে কৌশলে এমন বক্তব্য দিলেন, যাতে গোটা বাঙালী উজ্জিবীত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পথে হাঁটা শুরু করে।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে [১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত] আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পায়। সঙ্গত কারণে সরকারের গঠনের জন্য আওয়ামীলীগকে আহ্বান জানাবেন Ñএই হচ্ছে বিধি, নিয়ম। কিন্তু ১৯৭১ এর গোড়া থেকেই ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান নিয়ে তালবাহনা শুরু করে। ফলে পূর্ববাংলা ক্রমশ ফুঁসতে থাকে। ইয়াহিয়া বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা না দেয়ার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনা শুরু করলেও ১৩ ফেব্রুয়ারি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণায় ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়। ইত্যবসরে বাঙালী স্বাধিকার আর স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায় অনেকদূর।
১৯৭০ এর নির্বাচনের ফলাফলের আলোকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো হতাশা প্রকাশ করে ইয়াাহিয়াকে বলেন, মুজিবকে যেন ক্ষমতা দেওয়া না হয়, কারণ তিনি ক্ষমতায় গেলে পাকিস্তান ভেঙে দেবেন। ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের বহু রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে একমত হন যে, মুজিবকে ক্ষমতা দেওয়া যাবেনা, কারণ তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক এবং ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে খণ্ডিত করার জন্য।
পাকিস্তানী জেনারেলরাও বুনতে থাকে ষড়যন্ত্রের জাল। পাকিস্তানী জেনারেলরা নির্বাচনের এ ফলাফলের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাদের আশা ছিল কোনো রাজনৈতিক দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেনা। আর বেশি আসন পেলেও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল পাবে। কিন্তু হিসেবের হেরফের হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে যায় ইয়াহিয়া গং। শাসকের চেয়ার থেকে শাসিতের আসনে বসার অপমান এবং গ্লানিতে পেয়ে বসে তাদের। কোনো ভাবেই কোনো বাঙালীকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে চাইল না তারা। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হলে ভুট্টো এই অধিবেশন বয়কটের হুমকি দেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেন। ভুট্টোর এই প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যান করেন।
এদিকে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ায় সরকার গঠনের প্রস্তুতি শুরু করে আওয়ামী লীগ। গোটা দেশের মানুষও সেই কাক্সিক্ষত ক্ষণটির জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। ১ মার্চ ১৯৭১ হোটেল পূর্বানীতে চলছিল আওয়ামীল লীগ পার্লামেন্টারি পর্টির বৈঠক। দুপুর ১.০৫ মিনিটের সময় বেতারে আকস্মিক জনৈক ঘোষকের কণ্ঠে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে জারী করা হয় এক ঘোষণা। ওই ঘোষণায় বলা হয়, “পকিস্তান আজ চরম ভয়াবহ এবং রাজনৈতি সংকটের সম্মুখীন। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদান না করার সংকল্প প্রকাশ করেছে। এছাড়া ভারতের পরিকল্পিত উত্তেজনাকর পরিস্থিতি জাতির সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। আমি জাতীয় পরিষদের আহ্বান পরবর্তী কোনো তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম।’
অধিবেশন স্থগিত করার খবরটি নিমিষেই বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফুটন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে যেন লাভা উদ্গীরণ শুরু হয়ে যায় দেশ জুড়ে। জনতা লাটিসোটা নিয়ে নেমে আসে রাস্তায়। অল্পক্ষণের মধ্যে বাঁশের লাটি, লোহার রড, হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে হোটেল পূর্বনীতে। হিংসাত্মক ঘটনার আশংকায় বঙ্গবন্ধু সবাইকে শান্ত করেন। বিকেল ৪টার দিকে হোটেল পূর্বানীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে ২ ও ৩ মার্চ যথাক্রমে ঢাকায় ও সারাদেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হবে বলে তিনি জানান। কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ ব্যাপক হামলা চালায়। সেনাবাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করলে জনতার সাথে সংঘর্ষ হয়। গুলিতে নিহত হয় কয়েকজন। এরপর বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেদিনের প্রচারিত প্রথম নির্দেশ পত্রে ৩ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। বস্তুত সেদিন হতেই পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে।
সমগ্র জাতি তখন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় নিমজ্জিত। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ও দিকবদল হচ্ছিল। কি হতে যাচ্ছে তা আঁচ করাটা কঠিন ছিল। কারণ বাঙালী একদিকে উজ্জীবিত অন্যদিকে উদ্বিগ্ন। স্বাধীনতার নেশায় গোটা জাতি যেন জ¦লন্ত উনুনে টগবগ করে ফুটছিল। সেই কঠিন সময়ে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিতে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু আসেন রেসকোসের্র জনসমুদ্রে।
৭ মার্চের ভাষণের মূল উপজীব্য কি হবে, তা নির্দিষ্ট করতে এর আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটি একটানা ৩৬ ঘন্টা বৈঠক করে। কিন্তু সর্বসম্মত কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়। তখন উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনায় যা বলা আবশ্যক তা বলবেন বলে বঙ্গবন্ধু নিজের উপর দায়িত্ব তুলে নেন। এ ক্ষেত্রে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য: তিনি বলেছেন, … সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে … অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে … তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে।
এদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে গমগম করছিল রেসকোর্স ময়দান। ভাষণ শোনার জন্য সারা দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ জমায়েত হয় এই উদ্যানে। জাতির সংকটময় ওই মুহুর্তে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ শোনার জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে গোটা জাতি। রেসকোর্সের উত্তাল জনসমুদ্রের সভা মঞ্চে ‘রাজনীতির কবি [ঘবংিবিবশ ম্যাগাজিনের ভাষায় দচড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং’], বঙ্গবন্ধু এলেন জনসমুদ্রে। আমেরিকার বর্ণ বৈষম্য নেতা মার্টিন লুথার কিং এর মতো জনগণকে ‘একটি স্বপ্নের কথা’ বলতে নয়, বিদ্রোহে উত্তাল জনসমুদ্রকে স্বাধীনতা অর্জনে সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানাতে তিনি এলেন। ওই ভাষণটি ছিল মাত্র ১৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত ভাষণ। এ ভাষণে তিনি পকিস্তানী রাজনীতির ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস ব্যাখ্যা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ ব্যাখ্যা, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন নির্দেশ ঘোষণা, সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ সংগ্রামের শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেওয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যে কোন প্ররোচনার মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পরামর্শ দেন। তিনি ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ তিনি বলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও, শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ স্বাধীনতার লক্ষ্য নির্ধারক বেশ কিছু বক্তব্য রয়েছে এই ভাষণে। যেমন- ‘‘৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা।’’ “এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্শাল্লাহ।” এমনি সব উচ্চারণের বেশ কিছু দিক বিবেচ্য। তাৎক্ষণিক স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যে বঙ্গবন্ধুর উপর বেশ চাপ ছিল। অপরদিকে তা করলে তাৎক্ষণিক কি ভায়বহ প্রতিক্রিয়া হতে পারত তাও বঙ্গবন্ধু জানতেন। এমনি এক কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি যা বললেন, তা সরাসরি ও তাৎক্ষণিক স্বাধীনতা ঘোষণা না হলেও স্বাধীণতা ঘোষণার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন। সার্বিক পরিস্থিতি সম্যক অবহিত কোন বাঙালী বা বিদেশীর কাছে এই ভাষণের নিহিতার্থ দুর্বোধ্য থাকেনি সেদিন। জাতি দিক নির্দেশনা পেয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একজন দক্ষ কৌশলীর সুনিপুন বক্তব্য উপস্থাপন। দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বর্হিবিশে^ যাতে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত না হন এ ব্যাপারে তিনি সদা সতর্ক ছিলেন। তিনি ভাষণটি বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। এই ভাষণ ১৮ মিনিট স্থায়ী হয়। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য পরে বিতরণ করা হয়েছিল। এটি তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক কিছুটা পরিমার্জিত হয়েছিল। পরিমার্জনার মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা।
ওইদিন এ ভাষণ রেডিওতে সম্প্রচারের কথা ছিল। এর জন্য সমস্ত আয়োজনও শেষ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক জান্তা সরকারের নির্দেশে শেষ মুহুর্তে সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়। ফলে রেডিও’র কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা রেডিও অফিস বন্ধ করে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে যায়। এদিকে ভাষণ সম্প্রচার হঠাৎ বন্ধ করে দেয়ায় জনসাধারণ ধরে নিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির উপক্রম হয়। তখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ভাষণটি পরদিন ৮ মার্চ সকালে সম্প্রচার করতে রাজি হয়।
৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে ওই সময়ে ঢাকায় কর্মরত পাকিস্তানী মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার বক্তব্য প্রনিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, বেশীরভাগ লোকই বিশ^াস করেছিল যে ৭ মার্চের ভাষণটিকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণার কাজে লাগাবেন। ঐ রকম পরিস্থিতি সত্ত্বেও তিনি ওরকম কোনো ঘোষণা না দিয়ে বিপদ এড়ানো ও ঢাকার রাস্তায় বাঙ্গালীর রক্তপাতের সম্ভাবনা বাতিল করার জন্য কৃতিত্ব পাওয়ার অধিকারী।
বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। এরূপ ঘোষণাদানের ক্ষমতা, অধিকার ও কর্তৃত্ব যা কিছু একমাত্র তাঁরই ছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তা অর্জন করেন। সে কারণে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন মাওলানা ভাসানী সহ পূর্ব বাংলার প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আহ্বান জানাতে থাকেন।
১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সেদিন [৭ মার্চ] সমগ্র জাতির আবেগ অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা ও মনন অনুরণন ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চই হতে পারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। কারণ জাতীয়ভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা এ ভাষণের প্রতিটি উক্তিতে আপষহীন উচ্চারিত হয়েছে। ৭ মার্চের জনসভার পর ২৬ মার্চ পর্যন্ত আর কোনো বড় জনসভায় ভাষণ দেয়ার সুযোগ হয়নি বঙ্গবন্ধুর। প্রয়োজনও হয়ত ছিল না। কারণ দিক নির্দেশনা যা দেওয়ার ওই ভাষণেই [৭ মার্চ] দেয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে কালজয়ী ওই ভাষণই গোটা জাতিকে মুক্তির নেশায় বুঁদ করে সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। আর তাই ৭ মার্চ বাঙালীর জাতির ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া অবিস্মরণীয় এক দিন।
৮ মার্চ হতে বাংলাদেশের সর্বত্র আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া পূর্ব বাংলার সর্বত্র কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব এক প্রকার বিলীন হয়ে যায়। অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। শেখ মুজিবের ডাকে অসহযোগ আর আইন অমান্য আন্দোলন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা ওয়ালী খান বলেছিলেন, “ঊাবহ এধহফযর ড়িঁষফ যধাব সধৎাবষষবফ” এ প্রসঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেছিলেন, “গান্ধীজীও কোনোদিন ভাবতে পারেননি যে অসহযোগ আন্দোলন এমন সফলভাবে পরিচালিত হতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিল ১৯৪২ সালের ভারতÑছাড় আন্দোলনের চেয়েও অনেক বেশী।
২১ মার্চ আলোচনায় যোগ দেয়ার জন্য ভুট্টোও ঢাকায় এলেন। দিনের পর দিন আলোচনা চলল; কিন্তু অগ্রগতি নেই। সেই সময়ে বিবিসি’র সাংবাদিক মার্ক টালি বলেছিলেন ‘এ আলোচনা ফলপ্রসু হতে পারে না। কারণ আলোচনা চলছে দুই বন্দির মধ্যে। একজন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি অপরজন শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের হাতে বন্দি।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। অন্যান্য দিবসে পাকিস্তানের চাঁদ তারা খচিত জাতীয় পতাকায় আকাশ ছেয়ে যেত। এবার ব্যতিক্রম। ঢাকায় গভর্ণর হাউজ ও ক্যান্টমেন্ট ছাড়া সারা দেশে উড়ল স্বাধীন বাংলার পতাকা। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং ধানমণ্ডির বাড়িতে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ বাজিয়ে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। প্রকৃতপক্ষে ২৩ মার্চের উজ্জ্বল প্রতিরোধ দিবসের পর কি যেন এক কালোছায়া সবাইকে ঘিরে ধরে। চারদিক থেকে খালি নৈরাশ্যজনক খবর শোনা যাচ্ছিল। ইয়াহিয়া মুজিব ভুট্টোর বৈঠক যেন সমাধানের কোনো কূল কিনারা পাচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন প্রেসিডেন্ট ভবনে যাচ্ছেন আলোচনা করতে, বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলছেন, আলোচনা এগুচ্ছে; এদিকে আন্দোলনকারী জনতাকে বলছেন, দাবী আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যান।
উদ্বেগ আর অচলায়তনের চাতাল বিস্তৃত হতে থাকে দেশজুড়ে। আলোচনার নামে কালক্ষেপনের এক পর্যায়ে গণহত্যার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ইয়াহিয়া অকস্মাৎ উড়াল দেয় পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানী মেজর জেনারেল [অবঃ] খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট [ইয়াহিয়া] আসলে পূর্ব পাকিস্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার বা গোল্লায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান যেভাবে চলে চলুক। দেখা যাচ্ছিলো তিনি শুধু নিজের নিরাপত্তার কথাই ভাবছিলেন। ফলে তিনি অনেকটা গোপনেই ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সন্ধ্যা ৭টার সময় ঢাকা ত্যাগ করেন। এই চালাকীটি সম্ভবত একমাত্র তাকে ছাড়া আমাদের আর কাউকে বোকা বানাতে পারলো না।
শ্যামলী ঘোষ লিখেছেন, ২৫-২৬ মার্চ মাঝরাতে ও তারপর যা ঘটে তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কার্যত এটি এর পূর্ববর্তী ২৫ দিনে বিক্ষিপ্তভাবে যা ঘটেছে, তারই ব্যাপক ব্যাপ্তির ধারাবাহিকতা। তবে পার্থক্য ছিল এই যে, ওই ২৫ দিনে পূর্ব পাকিস্তান কার্যত এক বেসরকারি সরকারের আওতায় ‘বাংলাদেশে’ রূপান্তরিত হয় আর যুগপৎ মুখোমুখী হয় ওই সরকারের বিবেচনায় এক দখলদার সেনাবাহিনীর। ফলতঃ ১৯৭১ সালের ১৫ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিব এবং তাঁর সহযোগীদের আলোচানায় কি ঘটেছিল সে বিষয় অবান্তর। উভয় তরফের জানা উচিত ছিল, যে মোকাবেলা তারা এড়াতে চাচ্ছিল কিংবা যার মুখোমুখী হতে তারা ভয় পাচ্ছিল তাদের নিজ নিজ কারণে সেই মোকাবেলা অবধারিত, অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এই অনিবার্যতা যদি বেশী কিছু নাও হয়ে থাকে তা ছিল ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার অনুরূপ অনিবার্যতা।
তবু “আলাপ আলোচনার” একটি লোক দেখানো নামাবলী গায়ে চড়ানো হয়। তবে তাৎপর্যের বিষয় এই যে, এইসব আলোচনা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, এমনকি, ইয়াহিয়ার ইচ্ছানুসারে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত ছিল না। বরং এই আলোচনা ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের দেওয়া শর্তের কারণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সৃষ্ট ‘সংকট’ নিরসনের জন্য। অবশ্য আওয়ামী লীগের এই যে সব শর্তের কথা বলা হচ্ছে সেগুলি পূরণ করা হলেও আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশনে যোগ দেবে এমন নিশ্চয়তা ছিলনা। শেখ মুজিব শুধু একথাই বলেছিলেন যে, আশু দাবীগুলো মেটানো হলে আওয়ামী লীগ এই অধিবেশনে যোগ দেবে কিনা সেই বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে।
যদি কেউ এমন কল্পনাবিলাসী থেকেও থাকেন অন্তত শেখ মুজিব ও তার সহযোগীরা অবশ্যই সেইসব কল্পনাবিলাসীদের কেউ ছিলেন না। ঢাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের ড. নুরুল্লাহর কথা অনুযায়ী ১৯৭১ মার্চের ৭ মার্চের পরেই কিছু ছাত্রলীগার তাঁকে বিশ^বিদ্যালয়ের লভ্য যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি বেতার কেন্দ্র তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ জানায় ও পরে তাকে শেখ মুজিবের বাসভবনে নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানও তাকে একই অনুরোধ জানান। শেখ মুজিব তাকে বলেন, তিনি তাঁর দেশবাসীর কাছে তাঁর ভাষণ পৌঁছে দেওয়ার জন্যই ওটা কাজে লাগাবেন। ড. নুরুল্লাহ জানান, শেখ মুজিব বলেন “ আমি আমার শেষ ভাষণ দিতে চাই।”
শ্যামলী ঘোষ লিখেছেন, আলোচনা চলাকালে শেখ মুজিবের শান্ত ও সংযত মেজাজ বহিরাগতদের কাছে অসাধারণ স্থিতিশীল মনে হলেও তাঁর সহযোগিরা জানতেন তিনি তখন লড়ে চলেছেন এক হেরে যাওয়া খেলায়। হেরে যাওয়ার কারণ এই আলোচনায় আর কোনো ফল হবে না, বহু চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত আর রক্তপাত এড়ানো যাবে না। উভয় পক্ষ কেবল সময় কাটাচ্ছিল। ইয়াহিয়ার জন্য সময় দরকার ছিল আঘাত হানা চূড়ান্ত করার জন্য, মুজিবের সময়ের দরকার ছিল যারা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখবেন তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা সহ আরো কিছু কাজ সারার।
অপারেশন সার্চলাইট:
২৫ মার্চ’৭১ দিবাগত রাতে গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তার নাম অপারেশন সার্চলাইট। এটি শতাব্দির জঘন্যতম কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড। রাতের আঁধারে নির্বিচারে চলে গণহত্যা। আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের সকল সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়ে ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিজ দেশের স্বাধীকারকামী নিরস্ত্র নাগরিকের উপর শুরু করে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা।
এই অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করে পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। এই নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি নেই, কিংবা রাখা হয়নি। গণহত্যার পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। রেহমান সোবহান লিখেছেন, ঢাকার নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম তোপ দাগা হল ২৫ মার্চ রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে আমরা যখন কামানের গর্জন শুনতে পেলাম। ইপিআর এবং পুলিশ সদর দপ্তরের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্কেত ছিল এটা।
২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরপরই শহরেজুড়ে রটে যায় যে, ইয়াহিয়া চলে গেছে। আসলে এটি কোন রটনা ছিল না, ছিল চরম সত্য। মূলতঃ জেনারেল ইয়াহিয়া কড়া গোপনীয়তার মধ্যে ঢাকা ছাড়েন। কিন্তু বিষয়টি গোপন থাকেনি। ইয়াহিয়া ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছার সাথে সাথে খবরটি চলে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘সন্ধ্যা ৭টায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান পিএএফ গেট দিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকলেন বিমানে চড়ার জন্য। উইং কমান্ডার খন্দকার তার অফিসে বসে এ দৃশ্যটি দেখলেন। সাথে সাথে মুজিবকে জানিয়ে দিলেন। পনের মিনিট পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে একজন বিদেশী সাংবাদিক টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেজর প্রেসিডেন্ট কি চলে গেছেন, খবরটি কি সত্যি?’
ইয়াহিয়া চলে যাওয়ার খবর প্রচার পাওয়ার পর পরই আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় রাস্তায় হালকা ব্যারিকেড তৈরি করে। কিন্তু এই সব ব্যারিকেড পাকিস্তানী সৈন্যদের চলাচলে কোন তাৎপর্যপূর্ণ বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। পাকিস্তানী সৈন্যরা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয়। কারণ পাকিস্তানী ফিল্ড কমান্ডার চাইছিলেন যে বাঙালি সৈন্যরা যাতে প্রতিক্রিয়া করার কোন সুযোগ না পায়। সেনা বাহিনীকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৬ ঘণ্টা সময় দেয়া হয়। পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী আক্রমণ শুরু করার আগেই দ্রুততার সাথে ঢাকা শহরের সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
১০ম বাঙালি রেজিমেন্টকে সেনানিবাসে সহজেই নীরস্ত্র এবং পরে নিশ্চিহ্ন করা হয়। ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্টকে ঢাকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং শহরের উত্তরাংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়।
লে. জে. এ এ কে নিয়াজী লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সামরিক অভিযান শুরুর আগে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের আগে তিনি টিক্কাকে বলেছিলেন, “তাদেরকে খুঁজে বের কর।” টিক্কার নিষ্টুরতা দেখার জন্য ভুট্টো ঢাকায় থেকে গেলেন। ভুট্টো দেখতে পেলেন ঢাকা জ¦লছে।
তিনি জনগণের আর্তচিৎকার, ট্যাঙ্কের ঘড় ঘড় শব্দ, রকেট ও গোলাগুলির বিস্ফোরণ এবং মেশিনগানের ঠাÑঠাÑঠা আওয়াজ শুনতে পেলেন। সকালে টিক্কা, ফরমান ও আরবাবকে পিঠ চাপড়িয়ে ভুট্টো অভিনন্দন জানান। তিনি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশ^াস দেন। ভুট্টো তার কথা রেখেছিলেন। টিক্কা খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিপ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছিলেন। রাও ফরমান ফৌজি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং ব্রিগেডিয়ার আরবাব প্রথমে মেজর জেনারেল ও পরে লেঃ জেনারেল পদে উন্নীত হন। ২৬ মার্চ করাচি পৌঁছে ভুট্টো তৃপ্তির সঙ্গে ঘোষণা করেন, “আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।”
২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর সদর দফতরে অবস্থিত বেশিরভাগ নিরস্ত্র এবং অসংগঠিত ইপিআর সৈন্যদের আক্রমণ করে সারা রাত যুদ্ধ করার পর পরাজিত ও পরাভূত করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানী বাহিনী কোন বাধা ছাড়াই সহজে মিরপুরে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীকে গ্রেফতার এবং রাষ্ট্রপতি ভবন ও গভর্নর হাউস দখল করে নিতে সক্ষম হয়, কিন্তু অনেকে পালাতে সক্ষম হলেও অধিকাংশই হানাদার আক্রমণে শাহাদাত বরণ করেন।
১৮তম ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনিয়িমিত বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ চালায়, হলগুলোতে অবস্থানরত নীরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা করে, সাথে বেশ কিছু শিক্ষকদেরও হত্যা করে। ২৬ মার্চ সকালের দিকে হিন্দু এলাকা এবং পুরান ঢাকা আক্রমণ করা হয়।
রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশেরা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ধীরে ধীরে পরাজিত হয়। যারা বেঁচে ছিল তাদের বেশিরভাগ ধরা পড়ে কিংবা পালিয়ে যায়। ভোরের মধ্যে শহর দখলে চলে আসে এবং শহরব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত অনিয়মিত আক্রমণ চলতে থাকে। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করা ছাড়া অপারেশনের অন্যান্য লক্ষ্য অর্জিত হয়। শহীদ মিনার, দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয়, ডেইলি পিপলস কার্যালয়, রমনার কালী মন্দির ধ্বংস করা হয়।
হানাদার বাহিনী ২৭ মার্চে ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নিলে হাজার হাজার শহরবাসী নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গ্রামের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছে। পাকিস্তনী সৈন্যরা ২৬ মার্চের পর থেকেই ঢাকার বাইরে যেতে থাকে। ঢাকার পূর্ব পাশে অবস্থিত ডেমরা, উত্তরে টঙ্গী এবং দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জের দিকে অবস্থান নিয়ে শহরে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এপ্রিলের ১০ তারিখের মধ্যেই হানাদার বাহিনী দক্ষিণে পদ্মা নদী পর্যন্ত এবং উত্তরে টঙ্গী-নরসিংদী পর্যন্ত এলাকায় তাদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
পাকিস্তান বাহিনীর এই হামলা কখনো বিশৃঙ্খল ছিল নাÑছিল পূর্ব পরিকল্পিত। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বিবেচনা করলে তা দিবালোকের মতো পরিস্কার হয়। তারা আঘাত করে জাতীয় আন্দোলনের কেন্দ্র বলে বিবেচিত মোকামে, সেনানিবাস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তারপর হিন্দু সাধারণ ও জাতীয় আন্দোলনরত আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির উপর। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ঘরদুয়ার জমিজিরাত ফেলে সীমান্তের ঐপাড়ে চলে যাক, নয় দেশে থেকে চিতার স্বাদ গ্রহণ করুক।
আহমদ ছফা লিখেছেন, ইয়াহিয়া খান সরকারের পোড়ামাটি নীতির লক্ষ্য ছিল একাধিক। তারা আশা করেছিল এক কোটির কাছাকাছি হিন্দু জনসংখ্যা ভারতে চলে গেলে তাদের ধন সম্পদ, ঘরবাড়ি, ব্যবসা বাণিজ্য অন্যদের হাতে পড়বে। নতুন মালিকদের মধ্যে নতুন সমর্থক তৈরীর সম্ভাবনা পাকিস্তান সরকার দেখতে পায়। দুই নম্বরে ধরে নেয় এর ফলে বাঙালি সংস্কৃতির উপর হিন্দুয়ানী প্রভাবটাও কমে যাবে। তিন নম্বরে বাড়তি জনসংখ্যার বোমা ভারতে একটি স্থায়ী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার বীজ রোপন করবে। শেষ কথা পাকিস্তানি শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র এবং প্রধান বাঁধা হিন্দু সম্প্রদায়Ñএই বিশ^াস থেকে তারা বাংলাদেশকে নিহিন্দু করার মহাপ্রকল্প গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা:
অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর পরপরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াছ তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, ২৫ মার্চের কালো রাত্রি। রাত ৮-৯টা বৈঠকখানা ঘরে তখন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কর্ণেল ওসমানী, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, আমীরুল ইসলাম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ঘরে জায়গা নেই। বঙ্গবন্ধু পাশের বাথরুমে একেকজন নেতাকে ডেকে নিচ্ছেন এবং কানে কানে ফিস ফিস করে কথা বলে বিদায় দিচ্ছেন। আজ রাতেই ইন্দোনেশিয়ার মতোই সেই হত্যাকাণ্ড হতে চলেছে বাংলাদেশে। যদি পাক বাহিনী বাংলাদেশ আক্রমণ করেই বসে তবে নির্দেশ পাঠিয়েছি স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য। আমি যদি দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যাই তবে ঢাকা শহর সহ সমগ্র বাংলাদেশ নরপশুরা একেবারে ধ্বংস করে ছাড়বে। আমি তা সহ্য করতে পারবনা। তার চেয়ে মৃত্যুই আমার শ্রেয়।
“পাকিস্তানী সম্ভাব্য হামলা থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে যখন বলা হল, তখন তিনি বলেন, আমি নিজে যদি চলে যাই কাল দেশ স্বাধীন হলে পর যখন বাংলার মাটিতে ফিরে আসব আমার হাজার মা বোন ভায়েরা এসে যখন বলবে ‘মুজিব, তুমিতো নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সংগ্রাম করে জীবন রক্ষা করেছ, কিন্তু আমার স্বামী, আমার পিতা মাতা, আমার ভাই, আমার বোন এদের তুমি কি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলে, ফিরিয়ে দাও, তাদেরকে তুমি ফিরিয়ে দাও’Ñ তখন আমি তাদের কি জবাব দেব বলুন। না না, আমি পারিনা। আমি যেতে পারিনা। মরতে হয় মরব। মৃত্যুকে আমি কোনদিন ভয় করিনি।”
নিরস্ত্র নিরিহ জনগণের উপর রাতের আঁধারে বর্বর আক্রমণের পটভূমিতে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে পরদিন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই পাকিস্তান ভাঙ্গার দায় পাকিস্তান সামরিক জান্তা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাকিস্তান পিপলস পার্টিও নেতা ভুট্টোর উপর চাপিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে একজন দূরদর্শী দেশ নায়কের মত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার বরণ করেন।
২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে ফার্ম গেইটে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এরপর তারা পিলখানায় ইপিআর ও রাজারবাগে পুলিশের দুর্গ আক্রমণ করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে এ খবর তিনি পান। ফলে তিনি আরেকটি বার্তা ঢাকার টিএন্ডটি মারফত পাঠালেন। ঢাকার টিএন্ডটি এক্সচেঞ্জ তখনো খোলা ছিল। সর্বশেষ যে বার্তাটি তিনি পাঠালেন, তাতে বলা হয়Ñ পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফলেস এর সদর দপ্তর আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপর আক্রমণ করেছে। সমস্ত শক্তি জড়ো করে প্রতিরোধ করুন, আর স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিন। সেনা আক্রমণের সময় টিএন্ডটি এক্সচেঞ্জ খোলা থাকায় বিদেশী লেখক রবার্ট পেইন বিস্মিত হয়ে এ সম্পর্কে লিখেছেন: খবরটি কিভাবে কোত্থেকে এল তা ভেবে কেউ বসে থাকলনা। সারা পূর্ব পাকিস্তানের শহরে বন্দরে খবরটি ছড়িয়ে পড়ল। এটাই ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর প্রথম মারাত্মক ভুল যে, তারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল না করেই পিলখানা আর রাজারবাগে আক্রমণ চালায়।
এরপর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তার সর্বশেষ বাণী বাংলার মানুষের কাছে পাঠান। ওই বাণীতে তিনি বলেন, এই হয়ত তোমাদের জন্য আমার শেষ বাণী। আজ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। যে যেখানেই থাক, যে অবস্থায় থাক, হাতে যার যা আছে, তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিশ^াস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোল। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে যতদিন পর্যন্ত না দখলদার পাকিস্তানীদের শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিস্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টায় চূড়ান্তভাবে যখন নিশ্চিত হলেন যে, সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এবং মুক্তিকামী পুলিশ বাহিনীর উপর রাজারবাগে হামলা চালিয়েছে, তখনই তিনি জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অথচ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নেন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দেন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে; রাত ১২.২০ মিনিটে।
বঙ্গবন্ধু যেভাবে গ্রেফতার হন:
২৫ মার্চ যে সেনাবাহিনী অভিযান করবে, সে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু নিশ্চিতভাবে জানতেন। আর এ অভিযানে বঙ্গবন্ধু যে গ্রেফতার হবেন, তাও তিনি পূর্ব থেকে আঁচ করেন। এ কারণেই তাঁর সকল সহযোদ্ধাদের তিনি আগেভাগে নিরাপদ অবস্থানে সরে যাবার নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁর সে পরামর্শ শোনেন এবং গা ঢাকা দেন। তিনি কেন নিরাপদ ও নিরাপত্তা আশ্রয়ে না গিয়ে ধানমণ্ডির বাসায় রয়ে গেলেন এ প্রশ্নের উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক। এর উত্তর মেলে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে।
পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় অস্থায়ী সরকারি বাসভবনে বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের কাছে এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে বলেন, গ্রেফতার হওয়ার পর মৃত্যু অবধারিত এ কথা তিনি জানতেন। তা সত্ত্বেও তিনি গা ঢাকা দেওয়া কিংবা পালানোর চেষ্টা তিনি করেননি। কারণ পালানোর চেষ্টা করলে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করত এবং দোষ চাপাত বঙ্গালী চরমপন্থীদের উপর। বঙ্গবন্ধুর এ সাক্ষাতকারটি ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়। ওই প্রতিবেদনের নির্বাচিত কিছু অংশ ছিল এরকম, ক্রন্দনরতা স্ত্রী ও সন্তানদের চুম্বন জানিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। যাওয়ার আগে তিনি বললেন, আর হয়ত ফেরা হবে না। সে কথা অবশ্য তাঁরা নিজেরাও ভালোভাবে জানতেন।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বন্দুক উঁচিয়ে যখন নিচে নিয়ে এলো, তখন তাদের বন্দুকের খোচা লাগছিল বঙ্গবন্ধুর পিঠে। জীপের কাছে পৌঁছানোর পর কিছুটা শান্ত হয়ে এবং কিছুটা বেপরোয়া মনোভাব দেখিয়ে তিনি বললেন, আমি আমার তামাক ও পাইপ নিতে ভুলে গেছি। ও দুটো আমার চাই-ই চাই। বিস্মিত ও হতচকিত সৈনিকেরা তাঁকে ফের পাহারা দিয়ে ঘরে নিয়ে এলে তাঁর স্ত্রী তামাক ও পাইপ তাঁর হাতে তুলে দেন। এরপর তাঁকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়। যে বন্দিত্ব দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস স্থায়ী হয়। ওইদিনের (২৫ মার্চ’৭১) ঘটনাপ্রাবহ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আরো জানান, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করে সব দায় বাঙালীদের উপর চাপাতে চায়। এ রকম একটি ষড়যন্ত্রের কথা তিনি আগেই জেনে যান। তাদের পরিকল্পনা ছিল, ‘আমি ঘর থেকে বেরোনো মাত্রই তারা আমার গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়বে। তারপর বলবে বাঙালী চরমপন্থীরা এই কাজ করেছে। সে হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙালীদের বিরুদ্ধে সামরিক পদেক্ষপ নিতে বাধ্য হয়েছেÑ এমন দাবী তারা করবে। ঠিক করেছিলামÑ যে কোন মূল্যেই আমি নিজের বাসভবনে থাকব। সেখানে আমাকে হত্যা করুক। তাহলে সবাই জানবে পাকিস্তানীরাই আমাকে হত্যা করেছে [তারপর আমার রক্তে পরিশুদ্ধ হবে আমার স্বদেশ]।
সামরিক অভিযান অত্যাসন্ন এ কথা চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বড় ছেলে কামাল ও দুই মেয়েকে গোপন কোনো স্থানে আশ্রয় নিতে আগেই নির্দেশ দেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে একা ফেলে ধানমণ্ডির বসতবাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। তাঁর সঙ্গে ছিল শিশুপুত্র রাসেল। সে সময় কেউ জানতেননা যে, তাদের দ্বিতীয় পুত্র জামাল ওই ঘরে নিজের কক্ষে ঘুমাচ্ছিল। রাত ১০ টা নাগাদ বঙ্গবন্ধু খবর পেলেন, সেনাবাহিনী আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেনাসদস্যরা তাঁর বাড়ির চারদিক ঘিরে ফেলে। ওই সময় খুব কাছেই কোথাও একটি মর্টার বিস্ফোরিত হয়। সেনা আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি গোপনে কিছু কাজ সেরে রেখেছিলেন। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ চট্টগ্রামে একটি গোপন ঠিকানায় [সিক্রেট হেডকোয়ার্টার্স] ফোনে যোগাযোগ করেন এবং দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর শেষ বার্তা পড়ে শোনান। পরে যা একটি গোপন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। তাঁর সে বাণীর মোদ্দা কথা ছিল, তাদের নেতাদের পরিণতির কথা না ভেবে দেশের মানুষ প্রতিরোধে ঝাপিয়ে পড়ুক। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির ঘোষণাও তাতে বাণীবদ্ধ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু জানান [টেলিফোনে], তাঁর বার্তা প্রেরণের পর যেসব ইপিআর সদস্য ও আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক তাঁর বাসভবনে প্রহরারত ছিলেন, তিনি তাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
হাসান ফেরদৌস লিখেছেন, রাত ১২টা ও ১ টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে সেনা সদস্যরা গোলা ছুড়তে শুরু করে। তিনি উপরের তলায় কাপড় বদলানোর ঘরে তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ঠেলে পাঠান। তারা মাটিতে বসে পড়ে। সে সময় তাদের মাথার উপর দিয়ে গোলা বর্ষিত হচ্ছিল। অল্প সময় পরে সেনাদল জোর পূর্বক তাঁর বাসভবনে ঢুকে পড়ে। একজন দ্বাররক্ষী যে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে অস্বীকার করেছিল, সে সেনাদলের হাতে নিহত হয়। সৈন্যরা ঝড়ের বেগে উপরের তলায় ছুটে আসে। বঙ্গবন্ধু কাপড় বদলানোর ঘরে দরজা খোলে বললেন, থামাও, গুলি করা থামাও। গুলি করছ কেন? আমাকে যদি গুলি করতে চাও, করো। আমি তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু আমার দেশের মানুষ, আমার পরিবারের লোকজনের দিকে গুলি করছ কেন? আরেক দফা গুলি বর্ষণের পর, একজন মেজর আর গুলি না ছোড়ার নির্দেশ দেন। ওই মেজর বঙ্গবন্ধুকে জানালেন, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে বিদায় নেয়ার জন্য মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময় তাঁকে দেওয়া হয়। তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে কোলাকুলির করার পর বললেন, ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। তোমারা হয়ত আমাকে আর দেখতে পাবে না। কিন্তু আমার মানুষ মুক্তি পাবে এবং আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।
জেল জীবন বঙ্গবন্ধুর জন্য নতুন কিছু নয়। তবে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের ঘটনাটি একটি ভিন্নমাত্রার। গ্রেফতারের ঘটনাবলী নিয়ে একেক জন একেক ধরণের তথ্য দিয়েছেন। রেহমান সোবহান লিখেছেন, স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পরেই টিক্কাখানের নির্দেশে পাকিস্তানী সৈন্যরা ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে আটক করে। পাকিস্তানী কর্ণেল সাইয়েদউদ্দিনের নেতৃত্বে দুই ট্রাক ভর্তি পাকিস্তানী সৈন্য ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডি ৩২ নং বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, অপারেশন সার্চ লাইটের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৫০ সদস্যের একটি চৌকস কম্যান্ডোকে পাঠানো হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানী মেজর জাফর। ধানমন্ডিতে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাড়ি তারা সহজেই ঘেরাও করে। দোতলার শয়নকক্ষে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
অপরদিকে অপারেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানী মেজর জেনারেল [অবঃ] খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, ২৫ আর ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে লে. কর্ণেল জেড .এ খান খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই শেখ মুজিবকে বন্দি করতে সক্ষম হন। শেখ মুজিব অক্ষত ছিলেন এবং জিওসি হাউসের কাছেই একটি বালিকা বিদ্যালয়ে তাকে নিরাপদে রাখা হয়েছিল। প্রহরীর সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে আমি তাকে কমান্ড হাউসের গেস্টরুমে নিয়ে আসলাম। এক্ষেত্রে জেনারেল খাদিমের বক্তব্যই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কারণ ওই অপারেশনের নীলনকশা প্রণয়নও বাস্তবায়নের তিনি কমান্ডের চূড়ায় ছিলেন। গ্রেফতারের পর হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গাড়িতে করে আইন পরিষদ ভবনে নিয়ে যায়।
শেষ কথা:
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানিরা আদপে কোনো ফায়দা লুটতে পারেনি। তারা তাঁর কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিঘ্নকারী বা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রবাসী সরকারের মধ্যে বিভ্যান্তি সৃষ্টি করতে পারে, এমন কোনো বিবৃতিও আদায় করতে পারেনি। তাঁর কারাগারের পাশে তাঁর জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে দেখেও তিনি নতি স্বীকার করেননি। জেলের ভেতরে কবর খোঁড়ার দৃশ্য দেখিয়ে তাঁকে ভয় দেখাতে আসা সামরিক কর্মকর্তাদের তিনি বলেনÑ‘আমার শেষ ইচ্ছের প্রতি যদি সত্যিই তোমরা সম্মান প্রদর্শন করতে চাও তো আমার মৃতদেহটিকে বাংলাদেশে পৌঁছে দিও। আমাকে যেন আমার জন্মভূমিতে কবর দেয়া হয়।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ও বাংলা শীর্ষক এক নিবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক নিরঞ্জন মজুমদার লিখেছেন, ‘দেশে নেতা অনেক জন্মান। কেউ ইতিহাসের একটি পংক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউ বা একটি অধ্যায়। কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তাঁর জন্ম। ধ্বংস বিভিষিকা ও বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই পলি মাটিকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের চেতনায় শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখণ্ডকে শুধু তাদের মানসে নয়, অস্থিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তোলা এক মহা ঐতিহাসিক দায়িত্ব। মুজিব মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী নেতার মতো এই ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুনঃনির্মাণ করেছেন। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা।
২৩ বছরের পাকিস্তানী দুঃশাসনের যাতাকলে নিস্পেষিত বাঙালী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাক কায়েমী স্বার্থবাদীদের মোকাবেলায় রাজনৈতিকভাবে সশস্ত্র হয়ে ওঠেছিল। এরপর ৭১ এর মার্চে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে যখন ইয়াহিয়া তালবাহনা শুরু করে, তখন বাঙালী অস্ত্রে সশস্ত্র হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে তাদের মোকাবেলায়। ২৫ মার্চে’৭১ এর কালো রাতে হানাদার তরফে যখন প্রথম বুলেটটি ছোড়া হয় তখন বঙ্গবন্ধু সমস্ত দায়-দায়িত্ব পাকিস্তানীদের ঘাড়ে ছাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আর মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বাঙালী পৌঁছে যায় মুক্তির ঠিকানায়। বাংলার মুক্ত আকাশের আলো বাতাসে দোল খেতে থাকে লাল সবুজের পতাকা।
লেখক: কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সেক্রেটারি, সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের পরিচালক, চকরিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, দৈনিক চকোরী ও
www.dailychakori.com এর সম্পাদক ও প্রকাশক।