কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের মূল্যবান সম্পদ শামুক – ঝিনুক। সমুদ্র উপকূলে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা শামুক – ঝিনুকের আবাসস্থল। এসব আবাসস্থল থেকে শামুক – ঝিনুক সংগ্রহ করে উপকূলের অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে পেয়েছেন। এতে বানিজ্যিকভাবে বাড়ছে ঝিনুকের চাহিদাও।
ঝিনুকের খোলস থেকে চুন, অলংকার, গৃহ সাজসজ্জাকরণ উপকরণ তৈরি, পোল্ট্রি ও ফিশ ফিড মিলে ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে ব্যবহার এবং ঝিনুকের মাংসল অংশ চিংড়ি, মাছ ও হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে । বিশ্বের অনেক দেশে ঝিনুকের মাংস প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হিসেবে ব্যবহ্নত হয়। বাংলাদেশে সাধারনতঃ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষ ঝিনুকের মাংস খেয়ে থাকেন।
কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি, কুতুবদিয়া, উখিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপের অনেক মানুষ ঝিনুক সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
ঝিনুকের মাংসে রয়েছে প্রচুর পরিমানে মিনারেল ও প্রোটিন। শুধু বিদেশ নই, দিনদিন বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই খাবার। আজ থেকে ৫ বছর আগেও এক কেজি ঝিনুক মাংসের দাম ছিল ২৫০ – ৩০০ টাকা। বর্তমানে এক কেজি ঝিনুকের মাংস ২০০০ – ২৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়াও দাম বেড়েছে ঝিনুকের তৈরি অন্যান্য সামগ্রীও।
মহেশখালীর ঝিনুক আহরণকারী জমির উদ্দিন বলেন, শামুক -ঝিনুক কুড়িয়ে আমার সংসার চলে। জেটিঘাট ও সমুদ্রের পাশে গাছের শিকড় থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে থাকি। সাদা ঝিনুক চুন তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং অন্য কিছু ঝিনুক থেকে মাংস সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। প্রতি কেজি ঝিনুকের মাংস ২ হাজার থেকে ২৫০০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারি।
টেকনাফের ঝিনুক ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন বলেন, সমুদ্র থেকে শামুক -ঝিনুক সংগ্রহ করে চুন, ঘরের সাজসজ্জার উপাদান ও অলংকার তৈরি করে বিক্রি করি । এছাড়াও ঝিনুক মাংসেরও চাহিদা রয়েছে।
কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের তথ্য বলছে – বিশ্বের অনেক দেশে সামুদ্রিক ঝিনুক একটি দামী সীফুড হিসেবে ব্যবহ্নত হয় এবং এর উপর ভিত্তি করে নানা খামারও গড়ে উঠেছে। ১৯৯০ এর দশকে ভারত সামুদ্রিক ঝিনুকের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। সমুদ্রের লোনা পানির ঝিনুক চাষের সম্ভাবনা নিয়ে দেশে কোনো গবেষণা হয়নি। তবে সমুদ্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা আহরণের সম্ভাবনা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল। একযুগ আগের সেই জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী মোহনা, মহেশখালী, সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গায় প্রাকৃতিকভাবে মুক্তা উৎপাদনকারী পাঁচ প্রকারের ঝিনুকের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এরমধ্যে করতাল নামক এক প্রকার ঝিনুকে মুক্তার সন্ধানও তারা পান। পানির ১ মিটার হতে ২ মিটার গভীরতায় বালুকাময় তলদেশে ও ১৮ হতে ২২ পিপিটি লবণাক্ততায় একটি ঝিনুক গড়ে ৫টি হতে সর্বোচ্চ ১২টি মুক্তা মিলে যা জরিপে উঠে এসেছে । তবে পরিবেশ দুষণ, আবাসস্থলের পরিবর্তন, নির্বিচারে ঝিনুক আহরণ ইত্যাদি নানাবিদ কারণে বর্তমানে প্রাকৃতিক উৎস থেকে ঝিনুক ও মুক্তার প্রাপ্যতা অনেকাংশে কমে গেছে।
কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি, কুতুবদিয়া, উখিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপসহ প্রায় সমগ্র সমুদ্র-উপকূল মূল্যবান ঝিনুকের আবাসস্থল।
যুগ যুগ ধরে উপকূলীয় জনসাধারণ এসব এলাকা থেকে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে আসছে । জোয়ারের সময় শামুক-ঝিনুকগুলো উপকূলে ভেসে আসে। এসময় স্থানীয় লোকজন সেখান থেকে মুক্তা সংগ্রহ করেন। বিশ্বের অনেক দেশে ঝিনুকের মাংস জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খাবার হিসেবে খ্যাতি রয়েছে। শুধু মাংস নই, ঝিনুক থেকে পাওয়া মুক্তাও একটি সম্পদ । যা দিয়ে মূল্যবান অলংকার তৈরি করা হয়। এছাড়াও চুন, মাছের খাবার ও ঘরের সাজসজ্জার কাজেও ব্যবহার করা হয় ঝিনুকের উপাদান ।
শফিক জানান, মানুষ ও জলজ পরিবেশে উভয়ের জন্য ঝিনুক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলাশয় থেকে শৈবাল, জৈব পদার্থ এবং দ্রবীভুত ক্ষতিকারক উপাদান
যেমন- ভারী ধাতু দুরীকরণে ঝিনুকের ভুমিকা রয়েছে। তাই ঝিনুক প্রাকৃতিক পানি পরিস্কারক হিসেবে কাজ করে। জলজ খাদ্য শৃঙ্খলের ক্ষেত্রেও ঝিনুক একটি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান এবং এরা জলজ খাদ্য শিকলের বিভিন্ন স্থরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। ঘেরে ঝিনুক চাষের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দেশের মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়ন সম্ভব।
তিনি জানান, ইতিমধ্যে আমরা কক্সবাজার শহরের খুরুশ্কুলে পরীক্ষামূলক ভাবে সাদা ও সবুজ রঙের ঝিনুক চাষ শুরু করেছি। শুরুতেই বেশ ভাল ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি সামনে বানিজ্যিকভাবে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। এতে অনেক মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন।
শফিক আরও জানান, দেশে ১৯৯৯ সালে স্বাদুপানিতে পরীক্ষামূলক ভাবে মুক্তাচাষ শুরু হয়। এদেশে স্বাদুপানির ঝিনুকের ৬টি প্রজাতি এবং সামুদ্রিক লোনাপানির ঝিনুকের ১৪২টি প্রজাতি রয়েছে। উপকুলীয় এলাকার এসব ঝিনুক বিভিন্ন কাজে ব্যবহ্নত হলেও মুক্তা তৈরিই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ব্যবহার বলে তিনি জানান।
বিশ্বের প্রায় স্বল্প উষ্ণপ্রধান ও উষ্ণপ্রধান সামুদ্রিক জলাশয় ঝিনুকের আবাসস্থল। এরা সমুদ্রের স্বল্প গভীর হতে ৮০ মিটার গভীর এলাকায় বিচরণ করে। প্রায় ৩০টি সামুদ্রিক ঝিনুক প্রজাতির মধ্যে ৩টি সামুদ্রিক প্রজাতির ঝিনুক বাণিজ্যিক মুক্তা উৎপাদনে ভূমিকা পালন করে।