প্রসঙ্গ ‘চাটগাঁইয়া হথা আর গানর বৈডক’
শিল্পী সঞ্জিত আচার্য্য; চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রাজা হিসাবে খ্যাত। কল্যাণী ঘোষ আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গানের রানী। দুজনই চাটগাঁইয়া গানের লিজেন্ড।
চাটগাঁইয়া গানের কোনো আয়োজনে দাওয়াত দিয়ে যখন লিজেন্ড শিল্পীদের অপমান করা হয়, তখন তার প্রতিবাদ করাটা আমার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আমি চাটগাঁইয়া গান নিয়ে টুকটাক গবেষণা করি, শ্রদ্ধেয় কল্যাণী দিদির ভাষায় আঞ্চলিক গানের শিল্পীদের এমন অবমাননায় আমার চুপ থাকা সাজে না।
গত শনিবার থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামে (টিআইসি) ফেসবুক গ্রুপ ‘আঁরার চাটগাঁ’র উদ্যোগে ‘চাটগাঁইয়া হথা আর গানর বৈডক’ নামে একটি অনুষ্ঠান হয়েছে।
ওই গ্রুপের একজন প্রবাসী সদস্য মহসিন কাজী ভাইয়ের আমন্ত্রণে আমি অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম।
কাণায় কাণায় দর্শকপূর্ণ অনুষ্ঠানটি বেশ উপভোগ্য হওয়ার কথা ছিল। এই অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন গুণীজন অতিথি ছিলেন, যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক স্যার, সাবেক সচিব জামাল উদ্দিন আহমেদ, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কংজরি চৌধুরী, জলবায়ু গবেষক ও গীতিকার ড. আবদুল্লাহ আল মামুন ও নারীনেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু প্রমুখ।
সেখানে একঝাঁক তরুণতরুণী আঞ্চলিক ভাষায় গান গেয়েছেন, উপস্থাপিকা ও বক্তারা চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলেছেন, আঞ্চলিক ছড়া-কবিতা বলেছেন, আমার ভালোই লেগেছে।
গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। সবার বক্তব্যে বোঝা গেছে এই অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক একজন শিল্পী, যিনি মূলত আধুনিক ধারার গান করেন। সেদিন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা কাম শিল্পী একক, দ্বৈত ও সমবেত কণ্ঠে হাফ ডজন আঞ্চলিক গান গেয়েছেন, সম্ভবত তিনি একটা মার্মা ভাষার গানও গেয়েছেন, এসব দেখে মনে হয়েছে অনুষ্ঠানটি ওই শিল্পীর একক সংগীতানুষ্ঠান।
যাক-সেটা নিয়েও প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন উঠে তখনই যখন রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পীকে দিয়ে আবদুল গফুর হালীর আঞ্চলিক গান ‘ঢোল বাজের আর মাইক বাজের’ গাওয়ানো হয়, এবং ওই শিল্পী গানের মাঝখানে এসে সুর ভুলে যান, দর্শক-সারিতে হাসির রোল পড়ে। আচ্ছা, উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিল্পীকে দিয়ে কেন আঞ্চলিক গান গাওয়াতে হবে?
যাক আসল কথায় আসি। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা আধুনিক গানের সেই শিল্পী একটি আঞ্চলিক গান গাইবার ফাঁকে হঠাৎ বললেন, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের শিল্পীরা নাকি বড় বা সম্মানজনক কোন মঞ্চে গান গাইবার সুযোগ পান না, আঞ্চলিক গানের শিল্পীরা নাকি সারাজীবন ভ্যারাইটি শো, বলিখেলা ও বেতার-টিভিতে গান গেয়েছেন, প্রেস্টিজিয়াস কোন প্ল্যাটফরমে গান গাইতে পারেননি। এটা নাকি তাকে বেশ পীড়া দেয়, তাই তিনি এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছেন, আঞ্চলিক গানের শিল্পীদের বড় মঞ্চে গান করার সুযোগ দেবার জন্য।
আমি দেখলাম, অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা সেই শিল্পীর মুখে এসব অবাঞ্চিত কথা উচ্চারিত হবার সাথে সাথে দ্বিতীয় সারিতে বসা আঞ্চলিক গানের লিজেন্ড সঞ্জিত আচার্য্য দাদা আসন ছেড়ে উঠে গেলেন। একটু পর তিনি শিল্পী কল্যাণী ঘোষ দিদি ও শিল্পী গীতা আচার্য্য দিদিকে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন।
ফেসবুক গ্রুপ আঁরার চাটগাঁ’র এডমিন, অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা, আধুনিক গানের সেই শিল্পীর কাছে আমার প্রশ্ন : আপনি যে বললেন, আঞ্চলিক গানের শিল্পীরা কেবল ভ্যারাইটি শো বা বলিখেলায় গান গেয়েছেন, বড় কোন প্ল্যাটফরমে গাওয়ার সুযোগ পাননি-এটা কি সঠিক? আপনি কি জানেন ১৯৭৮ সালের দিকে আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ লন্ডনের রয়েল আলবার্ট হলে গান করেছিলেন, যে হলে তখন পর্যন্ত কেবল বাংলাদেশের শিল্পী হিসাবে রুনা লায়লা গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন! আপনি কি জানেন লন্ডনের মিলকা রেকর্ডিং থেকে শেফালী ঘোষের লং প্লে বের হয়েছিল?
এই যে সরাইপাড়ার সন্তান মোহাম্মদ নাসির, ১৯৩২ সালে কলকতার এইচএমভি থেকে বের হয়েছিল তার আঞ্চলিক গানের রেকর্ড, যেখানে নাসির গেয়েছিলেন, ‘চাঁন মুখে মধুর হাসি’ গানটা, আর এই গানের সংগীত পরিচালনায় ছিলেন কালজয়ী সংগীতজ্ঞ জগন্ময় মিত্র। এরপরও কি বলবেন আঞ্চলিক গানের শিল্পীরা শুধু ভ্যারাইটি শো বা বলিখেলায় গান গেয়েছেন?
আঁরার চাটগাঁ’র এডমিন সাহেব আপনি কি জানেন, তিরিশ পেরুনোর আগেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার চলচ্চিত্র ‘সাম্পানওয়ালা’ দিয়ে দেশ মাতিয়ে দিয়েছিলেন শিল্পী সঞ্জিত আচার্য্য, যে চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন অমর সংগীতজ্ঞ সত্য সাহা? সঞ্জিত আচার্য্যের সেই ‘সাম্পানওয়ালা’ সিনেমার গান ‘বাঁশখালী, মইষখালী’ গেয়ে নোলক বাবুরা ক্লোজআপ ওয়ান তারকা হয়! জানেন আপনি?
আচ্ছা, আপনি কি জানেন, চট্টগ্রামের চিরসবুজ আঞ্চলিক গান ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে’ গানটির মূল শিল্পী কে? অবশ্যই এম এন আখতার ও সাবিনা ইয়াসমিন। ১৯৭৭ সালে দ্বৈতকণ্ঠে গ্রামোফোন রেকর্ডে বের হয়েছিল গানটি।
চট্টগ্রামের একজন শিল্পী এম এন আখতার তখনকার দেশ-খ্যাত সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে কোন জাদুবলে দ্বৈতকণ্ঠে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন? অবশ্যই মেধা দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে, কারও কৃপায় নয়।
ফটিকছড়ির রত্নসন্তান মোহনলাল দাশ, যিনি কালজয়ী গান ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’ গানের গীতিকার ও সুরকার। আপনি কি জানেন ১৯৬৭ সালের দিকে আঞ্চলিক গানের এই গীতিকারের অমর সৃষ্টি ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’ গানটি বাংলাদেশ বেতারে রেকর্ড হয়েছিল বিশ্বখ্যাত গজল-শিল্পী মেহেদী হাসানের কণ্ঠে! জানেন আপনি?
আঞ্চলিক গানের স্বঘোষিত হর্ত-কর্তা-ভাগ্যবিধাতাকে বলি, আপনি কি জানেন স্বাধীনতার পর বিটিভির নবযাত্রা অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনেই গান করেছিলেন আঞ্চলিক গানের শিল্পী শেফালী ঘোষ, যেখানে জাতির পিতা শেফালী ঘোষকে অনুরোধ করেছিলেন ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা’ গানটি গাওয়ার জন্য।
এরপরও কি বলবেন, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের শিল্পীরা শুধু ভ্যারাইটি শো বা বলিখেলায় গান গেয়েছিলেন।
আচ্ছা, আঁরার চাটগাঁ’র আয়োজনে সঞ্জিত আচার্য্যের মতো কালজয়ী শিল্পীকে গান গাওয়ার জন্য ফোন করে দাওয়াত দিলেন অথচ দাওয়াতপত্রে উনার নামটাই দিলেন না, দাওয়াতপত্রে আরেক লিজেন্ড শিল্পী কল্যাণী ঘোষের নাম দিয়েও তাকে গাওয়ার সুযোগ দিলেন না; হেডমাস্টরখ্যাত সিরাজুল ইসলাম আজাদ, কল্পনা লালা, কান্তা নন্দী, বুলবুল আকতার বা আবদুল মান্নান, আহমেদ নুর আমিরী ও, শিমুল শীলের মতো তারকা শিল্পীকে ডাকলেনই না, তাহলে এটা ‘চাটগাঁইয়া গানর বৈডক’ কেমন হলো?
শেষ কথা :সেই সত্তরের দশক থেকে কালজয়ী শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতারের মতো শিল্পীদেরকেও ‘ভ্যারাইটি শো’র শিল্পী হিসাবে ট্রিট করে গেছেন কিছু সংগীত-মৌলবাদী, কিছু শিক্ষিত সুশীল। আজ চাটগাঁইয়া গানের জীবন্ত কিংবদন্তী সনজিৎ-কল্যাণীর সামনেই আঞ্চলিক গানের শিল্পীদের ভ্যারাইটি শো ও বলিখেলার শিল্পী আখ্যা দিয়ে আপনি সেই সুশীলদের কাতারে নাম লেখালেন। মনে রাইখেন শ্যাম-শেফালী এই অঞ্চলিক গান গেয়েই বিশ্বজোড়া প্রসিদ্ধি পেয়েছেন, সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক পেয়েছেন।
এই তো সেদিন, চট্টগ্রামের ডিসি অফিসের বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট একটি অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি সুংযুক্ত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভা শেষে তিনি শুনতে চাইলেন, একটি আঞ্চলিক গান-‘চাটগাঁইয়া নওজোয়ান আঁরা হিন্দু মুসলমান’ (রচয়িতা : অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী)।
সেখানে তাৎক্ষণিক পাওয়া গিয়েছিল আধুনিক গানের শিল্পী মোস্তফা কামালকে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ফরমায়েশকৃত গানটি শোনাতে পারেননি, সঞ্জিত আচার্য্যের বিখ্যাত ‘বাঁশখালী-মইষখালী’ গেয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। গান শোনে প্রধানমন্ত্রী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। যার গান শোনে প্রধানমন্ত্রীও মুগ্ধ হন, সেই সঞ্জিত আচার্য্যদের ভ্যারাইটি শো’র শিল্পী বলার সাহস কোথায় পেলেন ওই লোকটা? এই দৃষ্টতা ক্ষমার অযোগ্য।