চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের প্রায় ৭ কিলোমিটার গেছে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার ওপর দিয়ে। সদ্য নির্মিত এই রেললাইনের আশপাশের কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। গভীর রাতে এক্সকাভেটর দিয়ে চলছে মাটি কাটার উৎসব। কোথাও কোথাও জমির ১০-১৫ ফুট গভীর পর্যন্ত কাটা হচ্ছে মাটি। এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে রেললাইনটি। এভাবে মাটি কাটা বন্ধ না হলে রেললাইন ধসে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথটি গত বছরের ১১ নভেম্বর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে ঢাকা থেকে দুটি ট্রেন চলাচল করছে এই পথে। চালু হওয়ার আগেই গত বছরের আগস্টে কয়েক দিনের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই রেলপথ। বন্যার পানির স্রোতে রেললাইনের নিচে মাটি ধসে কয়েক জায়গায় বড় বড় গর্ত তৈরি হয়। কোথাও কোথাও রেললাইনও দেবে যায়। পরে মেরামত করে রেললাইনটি ট্রেন চলাচলের উপযোগী করা হয়। এখন আবার পাশের জমিতে মাটি কেটে কাঁচা এই রেলপথকে ঝুঁকিতে ফেলছেন মাটি ব্যবসায়ীরা।
রেললাইনের পাশের জমি থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত মাটি কেটে নেওয়া ‘ভয়ংকর কাজ’ বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রামের হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, টপ সয়েল কাটার ফলে রেললাইনের মাটিও সরে গিয়ে নিচু জায়গায় চলে যাবে। এসব ইটভাটার ফলে একদিকে যেমন আবাদি জমি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে, অন্যদিকে বিপর্যয় ঘটছে পরিবেশের।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা বলেন, রেললাইনের আশপাশে মাটি কাটা তো অবশ্যই চিন্তার কারণ। প্রশাসন নিশ্চয় এটি গুরুত্ব দেবে।
সরেজমিন দেখা যায়, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া অংশের তেমুহানি ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা ও কেরানীহাট অংশের প্রায় ৭ কিলোমিটার রেললাইনের আশপাশের টপ সয়েল কেটে নেওয়া হচ্ছে। রাত ৩টা থেকে ভোর পর্যন্ত এক্সকাভেটর দিয়ে এই মাটি কাটছে প্রভাবশালী এই চক্র। যেসব জমিতে মাটি কাটা হচ্ছে, সেগুলো রেললাইন থেকে মাত্র ৩০-৪০ ফুট দূরে। স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১০-১৫ ফুট পর্যন্ত মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়।
চট্টগ্রাম জেলার পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় ১২২টি ইটভাটা রয়েছে। যেখানে ৯১টিই অবৈধ। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় ৭৩ ইটভাটার ২৭টি বৈধ ও ৪৬টি অবৈধ। লোহাগাড়ায় ৪৯ ইটভাটার ৪টি বৈধ ও ৪৫টি অবৈধ। এসব ইটভাটায় বছরে অন্তত দুই কোটি টন মাটি লাগে। এ জন্য বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমি থেকে ১০-১৫ ফুট গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নেওয়া হয়।
জমির মালিকেরা মাত্র ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা বিঘা হিসাবে মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন।অনেকে বিক্রি না করলেও বাধ্য হচ্ছেন বিক্রি করতে। এমনও ঘটনা ঘটেছে, জমির মালিকেরা সকালে উঠে দেখেন, তাঁদের জমির টপ সয়েল রাতের আঁধারে কেটে নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, কক্সবাজার রেললাইনটি এখনো কাঁচা। এই রেললাইনের ৩০-৪০ ফুট দূরেও মাটি কাটা মানে রেললাইনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। কারণ টপ সয়েল মাটিকে ধরে রাখে। এটি চলতে থাকলে কক্সবাজার রেললাইন ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাতকানিয়ার উপজেলা প্রশাসন জানায়, এই আসনের নতুন এমপি আসার পর অভিযান জোরদার করা হয়েছে। শুধু চলতি মাসেই সাতটি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। গত মাসে ২০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে প্রায় ১৮ জনকে জরিমানার পাশাপাশি জেলহাজতেও প্রেরণ করা হয়।
সাতকানিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘রাত ৩টা থেকে ভোর পর্যন্ত টপ সয়েল কাটছে একটি চক্র। আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তারপরও তাদের থামানো যাচ্ছে না। কারণ, এই চক্রটি মাটি কাটার সময় বিভিন্ন জায়গায় মানুষ দিয়ে তদারকি করে। আমরা অভিযানের খবর পেলেই, আগেভাগেই সটকে পড়ে। তবু আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। আশা করি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারব।’
সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের এমপি এম এ মোতালেব বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই উপজেলা প্রশাসনকে এই বিষয়ে কঠোর হতে অনুরোধ করেছি।’
চকো/জে