সাস্কাচোয়ান প্রভিন্সকে বলা হয় কানাডার ইমিগ্রেন্ট বান্ধব প্রভিন্স। বছরের প্রায় পাঁচ মাস বরফে ঢাকা থাকে এই প্রভিন্স। কিন্তু ইমিগ্রেশন আইনের সহজতার কারণে প্রতিবছর এখানে প্রচুর ইমিগ্রেন্ট আসছেন। এখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা আট হাজারের কাছাকাছি। সামারের সময় বাংলাদেশিরা বিভিন্ন উৎসবে মেতে উঠেন। প্রতিবছর কানাডার সরকার ও স্থানীয় সিটি অব সাস্কাটুন বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য “ফোক ফেস্টিভ্যাল’র” আয়োজন করে।
এবছরও তিন দিনব্যাপী আয়োজিত “সাস্কাটুন ফোক ফেস্টিভ্যাল” ( ১৭,১৮,১৯ আগস্ট) শেষ হলো। Bangladeshi Community Association of Saskatchewan BCAS এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। তিনদিনব্যাপি Bangladesh Pavilion এর অনুষ্ঠানে তাঁরা যেভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন, তা সত্যিই আশ্চর্য হওয়ার মত। আমি অবাক বিস্ময়ে তিন দিনের প্রোগ্রামে তাঁদের দেশপ্রেম, অধ্যাবসায়, পরিশ্রম ও সেক্রিফাইসকে লক্ষ্য করেছি। আর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় বাকরুদ্ধ হয়েছি।
বাংলাদেশ হতে ১২ হাজার মাইল দূরে এসে (আমাদের বিপরীত প্রান্তে) তাঁরা যেভাবে বাংলাদেশকে বুকে ধারন করে আছে, বাংলাদেশের ভালবাসাকে তাঁরা যেভাবে লালন করে যাচ্ছে-তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। কি ছিল না- তাঁদের অনুষ্ঠানমালায়! ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, একক অভিনয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, আঞ্চলিক, ফোক, মাইজভান্ডারি, পল্লীগীতি, দেশাত্মবোধক, আধ্যাত্মিক সব ধরণের গান ও গানের সাথে নৃত্য -কিছুই বাদ যায়নি। ফ্যাশন শো’র মাধ্যমে বাংলাদেশের তাঁত ও জামদানিসহ বিভিন্ন শাড়ির প্রদর্শনি ও বীরংগনা চরিত্রের কোয়েল শারমিন জুসির একক অভিনয় মন ছুঁয়ে যায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ড.রাজীব পোদ্দারসহ অন্যান্যদের পারফর্মেন্স ছিল বেশ সুন্দর। এই অনুষ্ঠানে ছোট ছোট শিশুদের অংশগ্রহণে গ্রামবাংলার মানুষের জীবন-জীবিকা, বিবাহ সংস্কৃতিও বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
সৌখিন বাংলাদেশি শিল্পী ও শিশুদের মুখে যখন
“আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি,
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি……. ”
– শুনেছি, তখন আমি আবেগাপ্লুত হয়েছি। (দেশে আমরা না জেনে অনেক কমেন্ট করি)। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারি শিল্পীদের আলাদা ভাবে বলার কিছু নাই। ‘সবাই চমৎকার পারফর্ম’ করেছেন। তবে ‘সাস্কাটুন বাংলা স্কুলের’ শিশু শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা অবিশ্বাস্য সুন্দর। বয়সে এতো পিচ্ছি বলে এখনও ভালো করে কথা বলতে পারছে না-এমন শিশুদের তৈরি করে শাড়ি পরিয়ে গান-নাচ-অভিনয় করার জন্য মঞ্চে তুলে দেয়া হয়েছে এবং এই শিশুরা ‘শিক্ষক- অভিভাবকদের’ সম্মান রক্ষা করেছে চমৎকার পারফর্ম করে। তারা কানাডা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি পাশাপাশি তুলে ধরেছে।
সাথে বাংলাদেশি পণ্যে সাজানো স্টল গুলোও ভিন দেশিদের নজর কেড়েছে। পরিকল্পনা, উপস্থাপনা, অতিথি আপ্যায়ন-সব কিছুতে ছিল মুন্সিয়ানার চাপ। প্যাভিলিয়ন ম্যানেজার ড. আরিফ ওয়াহিদ খান , কো-প্যাভিলিয়ন ম্যানেজার শ্যামলী সাহা, কালচারাল চেয়ার ও উপস্থাপক রহমত মুন্সী বকুল চমৎকার ভাবে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে প্রানবন্ত করে রেখেছিলেন। দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য আয়োজিত র্যালির ধারণাটিও চমৎকার। ইসরাত পাপড়ির পরিকল্পনায় ফোক র্যালিতে সম্মিলিত ভাবে গাওয়া-
”তোমরা এক তারা বাজাইও না
দো’তারা বাজাইও না………
একতারা বাজাইলে মনে পইরা যায়
একদিন বাংগলি ছিলাম রে…. ” – গানের তালে তালে র্যালিতে অংশগ্রহণকারিদের নৃত্য বেশ মনোমুগ্ধকর। অনুষ্ঠানে বোনাস ছিল বাংলাদেশি উদ্যোক্তা কামনাশীষ দেব ও আরিফুর রহমান মামুনের মালিকানাধীন থ্রি স্টার হোটেল Confederation Inn এর সুলভ মূল্যের বাংলাদেশি খাবার। যা খাওয়ার জন্য কানাডিয়ান ও অন্যান্য দেশের অভ্যাগতরা লাইন ধরেছিলেন। অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন ও সাস্কাচোয়ান ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন গান ও নৃত্য পরিবেশন করে সাস্কাটুন সিটি মেয়র চার্লি ক্লার্ক ও স্থানীয় এমপিও অংশগ্রহণ করে।
“ফোক ফেস্টিভ্যাল” মূলত এই বিভিন্ন দেশ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার জন্য কানাডা সরকার ও স্থানীয় City of Saskatoon কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজন করা হয়। এবারের ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশ, ক্যামেরুন, চাইনিজ, ফ্রাঙ্কোফোন, জার্মান, ভারত, ভারতীয় মেটিস, আইরিশ, জাপান, নরওয়ে, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, স্কটিশ, শ্রীলঙ্কা, ইউক্রেনীয় কার্পাটি, ভিয়েতনাম ও ইরান অংশগ্রহণ করে।
১৭টি ভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হলেও নির্দিষ্ট ফি দিয়ে টিকেট নিয়ে ফ্রি সার্ভিসের মাধ্যমে দর্শকে ১৭টি দেশের প্যাভিলিয়ন পরিদর্শন করতে পেরেছে। অংশগ্রহণকারি দেশগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্ব স্ব দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে। আয়োজক কর্তৃপক্ষের ঘোষণায় আশা প্রকাশ করা হয়েছে-‘ বহুসংস্কৃতিতে সাস্কাটুন শহরকে প্রানবন্ত করার জন্য এবং পারস্পরিক ঐতিহ্য, ইতিহাস আবিষ্কার ও অন্বেষণ করার জন্য’ এই আয়োজন। ‘শহর ত্যাগ না করে বিশ্ব ভ্রমণ করার অতুলনীয় অভিজ্ঞতা অর্জনে জন্য এই ফোকফেস্ট বিখ্যাত।
ধন্যবাদ Bangladeshi community Association of Saskatchewan- BCAS এর কার্যকরী কমিটির সবাইকে- চমৎকার আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ধরার জন্য। সফল আয়োজনের জন্য BCAS প্রেসিডেন্ট Mohammad Azad ভাই, অন্যান্য যারা জড়িত ও Sponsor দের প্রতিও প্রানঢালা ‘অভিনন্দন’। এবং কৃতজ্ঞতা অপরিসীম-আমাকে অংশগ্রহণের
সুযোগ দেয়ার জন্য।
লেখক- মুহাম্মদ মুসা খান, কলামিস্ট। সাস্কাটুন, সাস্কাচোয়ান, কানাডা।