সি.ই, বাকল্যান্ড সাহেব লিখেছেন একজন দানবীর বিদ্যাসাগর মাসে সে সময় ৩৬থেকে ৫৪হাজার টাকা আয় করলেও টাকা উদবৃত্ত হওয়া দূরের বিষয় তাঁর ঋণ হত৷নিজের জীবন ছিল খুবই অনাড়ম্বর,কিন্তু ব্যক্তিগত দান, শিক্ষাবিস্তার ও বিধবা বিবাহে তাঁর আয়ের তুলনায় ব্যয় হয়ে যেত৷পরের দুঃখ,কষ্ট দেখলে সেই কষ্ট মোচন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য,কাউকে রিক্ত হাতে ফেরাতেন না,সর্বোপরি নিজের কাছে টাকা না থাকলে পরের কাছে ধার করে সেই সাহায্যপ্রার্থী মানুষটিকে সাহায্য করতেন৷জলের মত অর্থব্যয় করেছেন,পরিণামের কথা কোনওদিন ভাবেন নি,তাঁর ঋণ হবে না কার ঋণ হবে?
মাপ করবেন বিদ্যাসাগর মহাশয়কে মূল্যায়ন করার যোগ্যতা,ক্ষমতা,দক্ষতা কোনও কিছু আমার নেই,আছে শুধু একরাশ মুগ্ধতা৷তিনি ঠিক কোন কাজটি আমাদের জন্য করতে বাদ রেখেছিলেন আমার জীবদ্দশায় অনেকগুলি বসন্ত অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও অনুধাবন করে উঠতে পারি নি৷যাই হোক বিদ্যাসাগর মহাশয় খুব ভাল করে জানতেন সমাজের মহান আদর্শের বিরুদ্ধাচরণ করে,গুণ্ডামির আশ্রয় নেয় যারা,তারা আসলে এক একটা কাপুরুষ৷তিনি নিজের চরিত্র দিয়ে এইসব প্রতিবাদীদের চক্রান্ত ব্যর্থ করেছেন৷শোনা যায় পিতৃদেব ঠাকুরদাস ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন বিশেষত যখন তিনি বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন,এবং শেষ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেছেন,নিন্দাকে গুরুত্ব দেন নি,অপমান কে জ্ঞান করেন নি,প্রতিবাদীদের কটুবাক্যে কর্ণপাতও করেন নি৷তবে প্রতিবাদীরা শুধু প্রতিবাদে ক্ষান্ত দেন নি,তথাকথিত রক্ষণশীল সমাজের বাহুবলীরা নিজেদের আশ্রিত দুবৃত্তদের দিয়ে তাঁকে নানা ভাবে নির্যাতন করবার চেষ্টা করেছেন৷এমন কি প্রাণ সংহারের চক্রান্ত করেছেন৷একদিন বিদ্যাসাগর শুনলেন তাঁকে মারার চেষ্টা হচ্ছে,কলকাতার কোনও বিশিষ্ট ধনাঢ্য মানুষ সেজন্য লোক নিযুক্ত করেছেন,ধনাঢ্য লোকটির তাঁবেদাররা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভবিষ্যত নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় মগ্ন,সামান্য ভীত না হয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই বাড়িতে গেলেন। তাঁকে দেখে সবাই অপ্রস্তুত,নির্বাক। একজন বলল তিনি এখানে কি করতে এসেছেন। জবাবে বিদ্যাসাগর মহাশয় বললেন তাঁকে মারার জন্য তাদের খাওয়া-ঘুম সব নাকি উবে গিয়েছে,তাঁর খোঁজ করছে,সেইজন্য তিনি নিজেই সেখানে চলে এসেছেন। তাঁকে আর কষ্ট করে খুঁজে পেতে হবে না৷ লজ্জায় সবার মাথা যেন কাটা পড়ে। শোনা যায় এইসব খবর পাওয়ায় পিতৃদেব ঠাকুরদাস পুত্রের জন্য বীরসিংহ থেকে পাঠালেন শ্রীমন্ত নামে এক জেলে সর্দারকে। বিদ্যাসাগর মহাশয় কোথাও গেলে সঙ্গী শ্রীমন্ত,বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান কার্যক্ষেত্রে আরম্ভ হয়েছে। প্রায় মধ্যরাতে সংস্কৃত কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে তিনি দেখলেন ঠনঠনিয়া কালীতলায় কয়েকজন দুবৃত্ত দলবেঁধে তাঁকে আক্রমন করার জন্য তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে৷ এসব দেখে বিচলিত হওয়ার মানুষ বিদ্যাসাগর মহাশয় নন। তিনি গলা ঝাড়া দিয়ে শ্রীমন্ত কে ডেকে বললেন ‘কইরে ছিরে সঙ্গে আছিস তো? দুর্দান্ত লাঠিয়াল শ্রীমন্ত তাঁর পিছনে ছিলেন,তিনি উত্তর দিলেন ‘চল তুমি আমি ঠিক তৈরি আছি’৷ বলা বাহুল্য শ্রীমন্তের রুদ্রমূর্তি দেখে দুবৃত্তরা ভাবল নিজে বাঁচলে বাপের নাম। বলা বাহুল্য সেখান থেকে পালাতে তাদের বিলম্ব হয়নি৷
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আত্মসম্মানবোধের অনেক কাহিনী সবার জানা,আমাদের কাছে গর্বের,সেজন্য আরেকবার না হয় গর্বের সেই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হোক না!
১৮৪৬-৪৭সালের কোনও সময়ের ঘটনা বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক,জেমস কার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ,
কোনও প্রয়োজনে বিদ্যাসাগর কার সাহেবের
সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখেন তিনি টেবিলের উপর পাদুকা শোভিত পদযুগল সম্প্রসারিত করে
চেয়ারে বসে আছেন,বিদ্যাসাগরকে দেখেও পা নামালেন না৷
নিজের প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে বিদ্যাসাগর চলে গেলেও ঘটনার মীমাংসা হতে আর একটি ঘটনা বোধহয় প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষটির দরকার ছিল৷ কোনও দরকারে একদিন কার সাহেব বিদ্যাসাগরের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন তিনি টেবিলের উপর তাঁর তালতলার চটিশোভিত পদযুগল কার সাহেবের দিকে সম্প্রসারিত করে কথাবার্তা বলছেন৷
কার সাহেব চটে লাল, নালিশ ঠুকলেন উপরমহলে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে লিখিত
নালিশ কৈফয়ত তলব করা হলে তিনি লিখলেন
‘I thought that (natives) were an uncivilised race quite unacquainted with refined manners of receving a gentleman visitor.I learned the manners of which Mr Keer complains from the gentelman himself,a few days ago……
I behaved myself as respectfully towards him as he had himself done.’ এমন মানুষের জন্য বাঙালি গর্ব করবে বছরের পর বছর,যুগের পর যুগ৷বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্পর্কে বলা অথবা লেখা শুরু করা যায় কিন্তু শেষ হবে কিভাবে!
তবুও থামতে হয় তার আগে যে দাবি উঠেছে সারা বাংলা জুড়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মদিন ২৬সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় শিক্ষাদিবস পালন করতে হবে,সেই দাবির প্রতি পূর্ন সমর্থন জানিয়ে বলতে চাই বাঙালি মনীষা বিদ্যাসাগরের কাছে বাঙালি চিরঋণী সেই ঋণ জাতি কোনওদিন পরিশোধ করতে পারবে না,অন্তত আমাদের সেটুকু সুযোগ দেওয়া হোক,তাঁর জন্মদিন বঙ্গীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হোক,সেটুকু শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের অধিকার নিশ্চয়ই গোটা বাঙালি জাতির প্রাপ্য৷
গ্রন্থঋণ,বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ,বিনয় ঘোষ,কলিকাতা দর্পণ,রাধারমণ মিত্র৷