আমরা সবাই জানি আসামে অসংখ্য ট্রাইবের বাসস্থান। সেই সবার মধ্যে একটা নতুন নাম যোগ হলে বিশেষ কিছু হয়ত যায় আসে না। তবু একটু অবাক হতে হয়। কারন ট্রাইব বলতে আমরা বুঝি উপজাতি। কিন্তু টি-ট্রাইব বলে ঘোষণার দাবী উঠেছে আসামের চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের তরফ থেকে।
আসাম সরকার একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেনঃ- “অসম চৰকাৰে চিঠি নং AR. 32/2004/34, dated 31-09-2004 ৰ মতে প্ৰশাসনিক বিভাগ হিচাপে চাহ জনজাতি কল্যাণ বিভাগ ২০০৪ চনত গঠন কৰিছে”
সরকার এই ঘোষণার প্রসঙ্গে জানিয়েছেন আসামে প্রায় 1000 চা-বাগানে দেশের 53 শতাংশ চা উৎপন্ন হয়।আর আসামের অর্থনীতিতে এদের অবদান বিশাল। অথচ এই চা-শ্রমিকরা (যারা মুলত মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, অন্ধ্র, বিহার, পশ্চিমবাংলা থেকে এসেছে) আর্থিক ভাবে খুবই দুর্বল। তাই সরকার তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে।
দিনে কতকাপ চা খাই তা অন্য লোকে গুনলে মেজাজ খারাপ হতেই পারে। চা হল মাথা খোলতাই করার শ্রেষ্ঠ পানীয়। দমদম রেলওয়ে ষ্টেশনে কয়েক বৎসর আগেও বৃটিশ আমলের এনামেল করা বিজ্ঞপ্তি দেখেছিলাম-চা পানের উপকারিতা নীচে খান আট দশ উপকারের তালিকা।
চা-বাগান, আমরা সবাই জানি বৃটিশদের শুরু করা। উত্তর-বাংলা দার্জিলিং-এর চা বাগান আর বর্তমানে চা-বাগান শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা সবাই ভালোই জানি।
আমি বরং একটু ইতিহাস ঘাঁটি। কেমন করে আসামে গেল নানা এলাকা থেকে শ্রমিকরা।
আসামে চা-বাগান শ্রমিকদের সংখ্যা হেলাফেলা করার মত নয়। অনেকের ধারনা এদের সংখ্যা আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় কুড়ি শতাংশ। এই ২০% লোক বাকি ৮০% লোকের সাথে মেশে না। তারা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে চা-বাগানগুলোতেই। খুব সম্প্রতি অবশ্য পরিবর্তন শুরু হয়েছে।
আমি ইতিহাসে যাই।
এদের আসামে নিয়ে আসা হয়েছে। হ্যাঁ এরা নিজেরা আসে নি, বৃটিশ সরকার এদের নিয়ে এসেছে ১৮৬০ থেকে ১৮৯০ সালে।
১৮৪১ সালে প্রথমবার আসাম কোম্পানী ৬৫২ জনকে নিয়ে আসে। কিন্তু এরা প্রায় সবাই রোগে পড়ে মারা যায়, আর যে দুই চারজন বেঁচে ছিল তারা পালায়।
১৯৫৯ সালে তৈরী হল Workman’s Breach of Contract.। আইন বাঁচিয়ে শ্রমিক নিয়ে আসার দরজা খুলে গেল। শ্রমিক আনার জন্য আড়কাঠি বা দালাল লাগানো হল। ১৮৭০ সালে শ্রমিক নিযুক্তির জন্য সর্দার নিয়োগ প্রথা চালু হল। (যাঁরা বেশি সংখ্যায় শ্রমিক নিয়ে স্বল্পকালীন কাজ করেন তাঁরা ভালোই জানেন এই আড়কাঠি, দালাল আর সর্দার প্রথা বহাল তবিয়তে এখনও চলছে।)
১৮৫৯-এর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৮৬১-র ২৫ নভেম্বর আসাম কোম্পানী প্রথম লটে ২২৭২ জন শ্রমিককে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে পথেই মারা যায় ২৫০ জন।
১২ এপ্রিল ১৮৬১ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৮৬২ এই সময়ের মধ্যে নিয়ে আসা হল আরও ২৫৬৯ জনকে।
পয়লা মে ১৮৬৩ থেকে পয়লা মে ১৮৬৬ এই সময়ের মধ্যে নিয়ে আসা হল ৮৪,৯১৫ জনকে। এর মধ্যে ১৮৬৬ সালের জুন মাস অবধি ৩০ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
১৮৭৭ থেকে ১৯২৯ এই সময়ের মধ্যে আনা হয় ৪,১৯, ৮৪১ জন চা-বাগান শ্রমিককে।
অনেক সময়েই এদের আনার জন্য বাছা হত সেই সব এলাকা যেখানে এরা বৃটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছিল। ফলে সেই সব এলাকায় বৃটিশ সরকার শান্তি স্থাপন করতে পারলো সহজে।
এই শ্রমিকেরা এমন জায়গায় এলো যেখানে তারা চেহারায় ভাষায় সম্পূর্ণ বেমানান। ফলে এরা নিজেদের বৃহত্তর জনগনের থেকে দুরেই সরিয়ে রাখলো। অবশ্য হয়ত প্রথম দিকে তাদের সম্ভবত বাগান এলাকার বাইরে যেতেই দেওয়া হত না, এমন সম্ভবনা থাকছেই।
গোটা পৃথিবীতে প্ল্যান্টেশন বা বাগিচা শিল্পের বাড় বাড়ন্ত মুলত দাস শ্রমিকদের নিয়। শ্রম নিবিড় এই সব ছিল্পে মুনাফার হার বাড়াতে বিনামুল্যে শুধু খেতে দাওয়ার বিনিময়ে নিযুক্ত দাস ছিল শিল্পটির চালিকা শক্তি। তার জন্য আফ্রিকা থেকে ধরে আনা হত দাসদের। সবাইকে যে জোর করে ধরে আনা হত তা নয় কিন্তু, আফ্রিকার বিভিন্ন রাজা গোষ্ঠীপতিও ইয়োরোপিয়ানদের এই দাস সরবরাহ করত।
বৃটিশদের আইনে দাস ব্যবসা বেআইনি। তাই বৃটিশরা দাস নিয়োগ করত না। শ্রমিক নিয়োগ করত। বিহার মধ্যভারত থেকে দলে দলে লোক এই শ্রমিক অভিধা নিয়ে পাচার হয়েছে দুর দেশে, ত্রিনিদাদ, মরিশাস, ফিজি। তারা দাস নয়, কিন্তু তাদের ফিরে আসার কোন উপায় নেই।
এই একই পদ্ধতি প্রয়য়োগকরা হল আাসামের চা বাগানগুলোতে। দাস নয় শ্রমিক। জোর করে আনা হয় নি। আড়কাঠি মারফত আনা হয়েছে। তারা দাস নয়। তারা শ্রমিক। তাদের মজুরী দেওয়া হয়। একেবারে আইনসম্মত পন্থায় চলা বাগিচা শিল্প। বৃটিশ চা বাগিচা শিল্প।
চা বাগিচা শ্রমিকদের মজুরী দেওয়া হত। তবে অনেক সময় সেই মজুরী দেওয়া হত চা বাগানের নিজস্ব কয়েনে। যে কয়েন তাদের বাগানের গায়ে থাকা দুই চারটি দোকান ছাড়া কোথাও বিনিময় যোগ্য বলে বিবেচিত হয়না। ফলে কেউ বছর ভর প্রবল কিপ্টেমী করে অনেক কয়েন জমিয়া ভাবল এবার পালাই। না পালাতে পারবে না। কারন তার চা-বাগানের কয়েন দিয়ে ট্রেনের টিকিট নৌকার পারানি কিছুই দেওয়া যাবে না। বরং উল্টো সে ধরা পড়বে সে কোন চা বাগান থেকে পালিয়েছে। ধরা পড়ার পরের গল্প তো একদম সোজা।
না বৃটিশরা দাস ব্যবসা করতো না, তারা দাস খাটাতো না। তারা আইন ভঙ্গ না করে আইনি পথেই চালাত চা বাগানগুলো। তাই এদের কথা ভারতের কোন ইতিহাসে কোন গবেষণায় কোন নির্মমতায় ঠাঁই পায় না।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। চা বাগানের মালিকানা হস্তান্তর হয়েছে। মালিকানা হস্তান্তরের সাথে ঐ শ্রমিকদের প্রকৃতপক্ষে বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল না, বহু বহু কাল। একটু একটু করে বদলেছে। আজ তারা অন্তত বিনিময়যোগ্য মুদ্রায় মজুরী পায়। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তাদের সাথে তাদের শিকড়ের যোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কোতায় তাদের দেশ ছিল তা আজ তারা জানেই না।
আজ তারা সংখ্যায় অনেক বেড়েছে ঠিক, কিন্তু তারা এখনও নিজেদের চা-বাগানের গন্ডীর মধ্যেই আটকে গেছে। নানা জায়গা থেকে তাাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের সবার নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি আচার আচরন ছিল ভিন্ন। এই দীর্কালের তফাতে তার অনেক কিছু তারা সযত্নে ধরে রেখেছে যেমন তেমনি পাশের ঝুপড়ির পরিবারের সাথেও ঘণিষ্ঠতা হয়েছে। বাগানের মধ্যেই তাদের বিয়ে ঘর সংসার। তাদের পরবর্তী কয়েকটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। ফলে এই চা-বাগান শ্রমিকরা, যাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন উপজাতি, তাদের সবার সংস্কৃতি আর ধর্মাচরন নিয়ে এক সম্পূর্ণ নতুন সংস্কৃতির জন্ম হচ্ছে।
ধর্মে এরা হিন্দু। কিন্তু তা সেন্সাসের পাতায় লেখা মাত্র। এদের দেবতা মারাং-বুরু, মহাদেউ, চিংবংগা, এমন কত কি। উৎসব, হুলপুজা করমপুজা টুসু পুজা, আবার দেওয়ালী দুর্গাপুজাও বাদ যায় না। পুজায় বলি দেবার প্রথা আছে। উৎসবে সবাই মিলে একসাথে খাওয়া-দাওয়া বেশ চলে।
অনেকেই খৃষ্টান হচ্ছে। যারা খৃষ্টান হল তারা অবশ্যই বড়দিন পালন করে।
এদের মধ্যে মুরগীর লড়াই খুব জনপ্রিয়। বাল্যবিবাহও বেশ চালু আছে।
এখন এরা নিজেদের আলাদা একটি জাতি পরিচয় চায়। চাহ-জনজাতি (চা-বাগান শ্রমিক জাতি) বা টি-ট্রাইব। এখানেই এক সমস্যা। যদি কেউ চা বাগানে কাজ করে বলে তাকে আলাদা জাতি বলা হয়, তবে যারা মাছ ধরে বা ধান চাষ করে, বা কাপড় বোনে, অথবা ডাক্তারি করে, অথবা সিনেমা করে সবাইকে তো আলাদা জাতি বলে পরিচিতি দিতে হয়।
এদের প্রতি আসামের জনগনের সমবেদনা আছে ঠিকই, কিন্তু আলাদা উপজাতি সংজ্ঞা দেবার ব্যাপারে আপত্তি আছে। আপত্তির মুলে অন্য কথা। উপজাতি বললে এদের কিছু বিশেষ সুবিধা প্রাপ্য হয়, যা কি না অন্যদের ভাগ থেকে কমে যাবে। কিন্তু সে সুবিধা পাবার তো এরা যোগ্যই বটে, সেটাও অস্বীকার করা যায় না।
জানি না, এরা তো প্রত্যেকেই কোন না কোন উপজাতির লোক। সেক্ষেত্রে সেই উপজাতি নেমপ্লেট ব্যবহার করলেই তো সহজ সমাধান হতে পারে। সেটা যখন হচ্ছে না, হয়ত আরো কোন না বলা কথা আড়ালে আছে।
দেখা যাক ভবিয্যত কি বলে। ©তুষারমুখার্জী।
তথ্যসুচীঃ-
1. https://teatribes.assam.gov.in/…/%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0…
অসম চরকার, চাহ জনজাতি চাহ জনগোষ্ঠীৰ বিষয়ে
2. http://www.xahitya.org/…/%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A6%AE…/
3. xahitya.org. 2016, অসমর ছয় জনগোষ্ঠীর-জনজাতি