শেখ কামাল মানুষ হিসেবে কোমল হৃদয়ের ব্যক্তি, প্রকৃতঅর্থে শিল্পমনা পরিশীলিত একজন মানুষ। তিনি মানবদরদি ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ ছিলেন। তিনি আচার Ñ আচরণে অতি সহজসরল, সদালাপী, সদা হাসিখুশি মনখোলা প্রাণবন্ত যুবক। সাদামাটা পোশাক পরতেন, কোনো বাহুল্য ছিল না।
নিরঅংহকার, দরদি হৃদয়ের সৎ মানুষ ছিলেন শেখ কামাল (অধ্যাপক আসলাম ভূঁইয়া, শহীদ শেখ কামাল : শিল্প – সাহিত্য ও ললিতকলা চর্চার স্মৃতিকথা, শহীদ শেখ কামাল : আলোমুখী এক প্রাণ, মো: জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি, সম্পাদিত, জয়ীতা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০, পৃ. ৫৪)। শেখ কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক শিক্ষায়ও সমান পারদর্শী হয়ে ওঠেন। শিক্ষার প্রাথমিক প্রভাব মানুষকে ধীরে ধীরে মানবিক ও সামাজিক মানুষ করে গড়ে তোলা। শেখ কামালের জীবনে শিক্ষার প্রভাবকে ক্ষমতা ও অর্থ কখনো পরাভূত করতে পারেনি। উচ্চশিক্ষা শেখ কামালকে কখনো গণবিচ্ছন্ন করতে পারেনি বরং দিন দিন গণমুখী করেছে। তাঁর রাজনীতি ও সংস্কৃতি ছিল তাই সর্বদা জীবনকেন্দ্রিক ও বাস্তবমুখী।
শেখ কামালের জন্ম তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তবে তিনি লেখাপড়া করেছেন শহর ঢাকায়। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হবার কারণে পিতার সাথে পুত্রের তেমন একটা সংযোগ ছেলেবেলায় গড়ে ওঠেনি। এমনকি শিশু শেখ কামাল পিতার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তবে লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা সেগুনবাগিচায় ডনস্ স্কুলে। ১৯৬৭ সালে ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন। আর সেই বছরই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেই সময়ে জাতির সামনে অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। শেখ কামাল মনেপ্রাণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কামনা করেন এবং স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য যে শেখ কামাল ভারতে গিয়ে ১৪ সপ্তাহের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষে সামরিক কমিশন লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর এডিসি (এইড-ডি ক্যাম্প) হিসেবে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন।
দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন তরুণ ক্যাপ্টেন হিসাবে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে আবার পড়ালেখায় ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পুনরায় পড়ালেখা শুরু করেনে। স্বাধীন দেশে হাজারো সমস্যা মোকাবিলা করে উচ্চতর পড়ালেখা অব্যাহত রাখেন।
আর সাথে সাথে নানা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা জোরদার করেন। ১৯৭৪ সালে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সম্মান শেষ পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে এমএসএস চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে ১২ আগস্ট মৌখিক পরীক্ষা দেন। ১৫ আগস্ট মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়। সেই পরীক্ষাতেও তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
শেখ কামালের বাল্যকালের বন্ধু সৈয়দ শাহেদ রেজা। আবার সহপাঠীও । শেষ কামাল সম্পর্কে জনাব সৈয়দ শাহেদ রেজা বলেন : “আমি শেখ কামালের আহবানে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। ঢাকা কলেজ শাখার ছাত্রলীগ থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন সেরা সংগঠক ছিলেন শেখ কামাল।
১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষা সপ্তাহ হয়, সেখানে কামাল সেতার বাজিয়েছিলেন। আমি কোন অনুষ্ঠানে প্রথম সেতার বাজানো দেখলাম। কী সুন্দর ছিল ! এখনো বার বার সেটা মনে পড়ে। কামাল পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সেতার বাজানো প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তিনি নিয়মিত ছায়ানটে সেতার বাজানো চর্চা করতেন।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সময় শেখ কামাল ১০-১২জন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে গোল হয়ে মাঠে বসে গান করেছেন। সমাজবিজ্ঞানে পড়েও সব বিভাগের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করেছেন” (সৈয়দ শাহেদ রেজা, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের পুরোধা শেখ কামাল, শহীদ শেখ কামাল : আলোমুখী এক প্রাণ, মো: জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি, সম্পাদিত, জয়ীতা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০, পৃ. ৮৯)।
শেখ কামালের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার বাইরেও আগ্রহের পরিসর ছিল ব্যাপকতর। যেহেতু আমরা শেখ কামালকে খুব বেশি একটা জানি না তাই অন্যদের কাছ থেকে তথ্য খুঁজতে হয়। শেখ কামালের বিশেষ গুণ ও বইপড়ার আগ্রহ সম্পর্কে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও মুক্তিযোদ্ধা জনাব ওয়ালিউর রহমান বলেন: “বই ছিল তাঁর প্রাণ, অজানাকে জানার প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর মধ্যে।
শেখ কামাল যখন ১৯৭২ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেনেভায় এলেন, এখানে থাকা কালে শেখ কামালকে তেমন একটা দেখা যেতনা বাইরে, বইয়ের মাঝে নিজের একটি বলয় তৈরি করে রেখেছিলেন তিনি। বাইরে যতটুকু সময় কাটাতেন, রেয়ার বই খুঁজতেন তিনি। অনেকের অনেক শখ থাকে, পোশাক থেকে শুরু করে ব্র্যান্ডের জিনিষপত্রের প্রতি আগ্রহ থাকে, শেখ কামালের এগুলোর কিছুই ছিল না, তিনি চাইতেন বই, অজানাকে জানার জন্য বই ছিল তাঁর প্রিয় বন্ধু” (ওয়ালিউর রহমান, সাধারণের মাঝে অনন্য-সাধারণ শেখ কামাল, শহীদ শেখ কামাল : আলোমুখী এক প্রাণ, মো: জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি, সম্পাদিত, জয়ীতা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০, পৃ. ৬১)। শেখ কামাল সত্যিকার অর্থেই বহুমাত্রিক প্রতিভাবান ছিলেন। তাঁর শিক্ষার কোনো সীমা ছিল না Ñ পরিসর ছিল ব্যাপকতর তেমনি অজানাকে জানার, নতুন নতুন উদ্ভাবনার বাসনাও ছিল বিস্তৃততর। তাই তিনি শিক্ষা অর্জনের সাথে সাথে শিক্ষাসংস্কার নিয়েও নানা প্রয়াস চালিয়েছেন।
শেখ কামাল অত্যন্ত সমাজসচেতন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সবাইকে জাদুকরের মতো দ্রুত আপন করে নিতেন। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন এক মহান শিল্পী। অভিনয়শিল্পী, সেতারবাদক, বিতর্ক এবং উপস্থিত বক্তৃতাসহ সাহিত্য-ললিতকলার সব শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল (অধ্যাপক আসলাম ভূঁইয়া, ‘শহীদ শেখ কামাল : শিল্প-সাহিত্য ও ললিতকলাচর্চার স্মৃতিকথা’, শহীদ শেখ কামাল : আলোমুখী এক প্রাণ, মো. জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি সম্পাদিত, জয়ীতা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০, পৃ. ৫৪)।
ইতিহাস থেকে দেখা যায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শেখ কামালের দৃষ্টিতে এসেছে কেনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন। তাঁর এই শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় নাই। তাই আক্ষেপ করে অধ্যাপক ফারুক বলেন : “তবে শেখ কামাল সম্পর্কে যাঁরা লিখেছেন বা আলোচনা করেছেন, তাঁরা একটি সত্য এখনো প্রকাশ করেননি। এটি তাঁদের না জানার কথা নয়। হয়তো তাঁর অনেক অবদানের ভিড়ে সেটি তাঁরা উল্লেখ করে উঠতে পারেননি। সেটি হলো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন নামে একটি আন্দোলন শুরুর কথা (আ.ব.ম. ফারুক, ‘শেখ কামাল ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন’, শহীদ শেখ কামাল : আলোমুখী এক প্রাণ, মো. জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি সম্পাদিত, জয়ীতা প্রকাশনী, ঢাকা, আগস্ট ২০২০, পৃ. ৫৫)।
বর্তমানে বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে গুরুতর সংকটে পতিত হয়েছে বাংলাদেশ। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা নাই, কোনো প্রকাশনা নাই। আন্তর্জাতিক বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ^বিদ্যালয় কোনো ধরনের মর্যাদার আসন অর্জন করতে পারছে না। তাই দেশের জ্ঞানশীল ও চিন্তাশীল মানুষের সামনে শিক্ষাসংস্কার নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব দেখা দিয়েছে। তাই শেখ কামালের শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে সামনে এসেছে। শেখ কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনের দাবিসমূহের অন্যতম ছিল শিক্ষার পরিবেশ উন্নতকরণ ও বিশ^বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
শেখ কামালের শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে অধ্যাপক আ. ব. ম. ফারুক বলেন :
কামাল ভাইয়ের নেতৃত্বে এ আন্দোলনের মূলকথা ছিল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রথিতযশা শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঠ নিচ্ছেন। এর পাঠ্যসূচি ও শিক্ষকেরা যেমন উন্নত, শিক্ষার পরিবেশটুকুও তেমনই উন্নত হওয়া চাই। পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব সবটুকুই প্রশাসনের এমন ভাবলে চলবে না, শিক্ষার্থীদেরও এ ব্যাপারে অনেক কিছু করার আছে। তিনি এ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আহ্বান জানালেন প্রতিটি বিভাগ থেকে সবচেয়ে মেধাবী তিনজন করে শিক্ষার্থী এতে যোগ দিতে না চান, তাহলে তার পরের মেধাবী জন যোগ দিবেন। তিনিও না এলে পরের জন। আর স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হলো প্রতি বিভাগ থেকে একজন করে সবচেয়ে মেধাবী মুখ নিয়ে। এই প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষার্থীরা পুরুষ না মহিলা তা বিবেচ্য নয়। সবার অধিকার সমান।
কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতি মাসে একবার টিএসসিতে বৈঠকে বসবে। আর স্টিয়ারিং কমিটি বসবে প্রয়োজনমতো, তবে দুই সপ্তাহে অন্তত একবার। আবহাওয়া প্রতিকূল না থাকলে সভা বসার ব্যাপারে কামাল ভাইয়ের প্রথম পছন্দ ছিল খেলার মাঠ। আমরা এভাবে কলাভবন, কার্জন হল, সায়েন্স অ্যানেক্স ও টিএসসি ঘুরে ঘুরে অনেকবার বসেছি (আ.ব.ম. ফারুক, শেখ কামাল ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন, শহীদ শেখ কামাল : আলোমুখী এক প্রাণ, মো. জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি সম্পাদিত, জয়ীতা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০, পৃ. ৫৬ ও ৫৭)।
শেখ কামালের সহজাত কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি ছিলেন অফুরন্ত প্রাণশক্তির গতিময় বর্ণিল প্রতিভাবান। আবার তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র ও সদালাপী। তাই বলা যায় তিনি একজন বিরল চরিত্রের অসাধারণ মানুষ। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেও কেমন করে সর্বসাধারণের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে রাজনীতি ও সংস্কৃতিসাধনা করা যায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত হলেন শেখ কামাল। তাই শেখ কামালের শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে অধ্যাপক আ. ব. ম. ফারুক বলেন, “ শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে হয়। তখন অধিকাংশ মেধাবী রাজনীতিমুখ ছিলেন না। তাই কেন্দ্রীয় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং ছাত্রলীগের পাশাপাশি ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজবাদী ছাত্রজোট প্রভৃতি সংগঠনের সদস্য। কিন্তু অন্য ছাত্রসংগঠনের হলেও তাঁদের সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করতে কামাল ভাই বা অন্যদের কারও কোনো সমস্যা হয়নি” (আ.ব.ম. ফারুক, ‘শেখ কামাল ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন’, শহীদ শেখ কামাল : আলোমুখী এক প্রাণ, মো. জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি সম্পাদিত, জয়ীতা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০, পৃ. ৫৭)।
লেখক পরিচয় : সাদাত উল্লাহ খান
সম্পাদক, প্রতিবুদ্ধিজীবী
ফোন : ০১৯১১২১৬৩৬৮
ইমেল : sadatkhan1965@gmail.com