স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ( এসটিপি) না থাকায় পর্যটন নগরী কক্সবাজারের পাঁচশতাধিক হোটেল মোটেল-গেস্টহাউস, কয়েক হাজার আবাসিক বসতবাড়ি ও হ্যাচারি থেকে প্রতি বছর নির্গত ১৫০ টন বর্জ্য সাগরে মিশে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সাগরের পানি দুষিত হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। আর প্রভাব পড়ছে সাগরে প্রাণী জীববৈচিত্রের উপর। পানিতে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভবিষ্যতে কক্সবাজার বিমুখ হবে পর্যটক।
পর্যটক না আসলে পর্যটন শিল্প নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে এ শিল্পের সাথে জড়িত কয়েক লাখ লোক বেকার হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় সাগরের পানি দূষণমুক্ত রাখতে কক্সবাজারে একটি সেন্ট্রাল এসটিপি স্থাপনের দাবি উঠেছে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছেন এসটিপি নিয়ে কাজ করছে তারা। তথ্য মতে, কক্সবাজার হোটেল- মোটেল জোন এলাকায় পাঁচ শতাধিক বাণিজ্যিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস রয়েছে। রয়েছে রেস্তোরাঁও। কিন্তু শুধুমাত্র ৬ টি হোটেলে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) রয়েছে। আর কোন আবাসিক হোটেলে এসটিপি নেই।
এছাড়া শহরে নির্মিত কোন আবাসিক ভবনেও নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ফলে তাদের তৈরি বর্জ্য যাচ্ছে সাগরে। বিশেষ করে বর্ষাকালে মানব বর্জ্য ফেলা হয় সাগরে।
সেই সাথে যুক্ত হচ্ছে পাহাড় কাটার বালিও। এতে সাগরের তলদেশ ভরাট হচ্ছে। মানব সৃষ্ট বর্জ্যে সাগরের পানি দূষিত হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কোন দপ্তর। এ অবস্থায় একটি সেন্ট্রাল এসটিপি স্থাপনের দাবি আরো জোরালো হয়ে উঠে।
সম্প্রতি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) পক্ষ থেকে ১৩৪টি হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ, কটেজকে ‘এসটিপি’ স্থাপন সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। মাত্র ৬ টি হোটেল এসটিপি রয়েছে বলে চিঠির উত্তরে বলা হয়। আর ৩৯টিতে ৩ চেম্বারবিশিষ্ট সেপটিক ট্যাংক রয়েছে বলে জানানো হলেও বাকি ৮৯টি হোটেলে চিঠির কোন উত্তর দেয়নি। এ অবস্থায় সেন্ট্রাল এসটিপি বসানো নিয়ে পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজ এবং হ্যাচারি মালিকদের সাথে মতবিনিময় সভা করেছে কউক।
সভায় কউকের প্রকৌশলী খিজির খান জানান- প্রতিবছর ১৫০ টন বর্জ্য সাগরে মিশে যাচ্ছে । এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন- বর্জ্যে সাগরের পানি দুষিত হওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হবে পরিবেশ। যার প্রভাব পড়বে সামুদ্রিক প্রাণী সম্পদের উপর । সৈকতে গোসল করতে না পারলে কক্সবাজার বিমুখ হবে পর্যটকরা। এতে পর্যটন শিল্প নিয়ে সরকারের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার এবং এনভায়রমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবু শরীফ মোঃ মাহবুব-ই-কিবরিয়া বলেন, সেন্টমার্টিনে পয়:বর্জ্যের কারণে ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কক্সবাজারে এর প্রভাব আরো বেশি পড়তে পারে। এতে চর্মরোগ ও ডিসেন্ট্রি রোগের প্রভাব দেখা দিতে পারে। এছাড়া প্লাস্টিক, জেলেদের জাল, পোড়া তেল, সেন্ডেলসহ অন্যান্য বর্জ্যের কারণে সাগরের পানি বিষাক্ত হয়ে প্রাণী জগতের ক্ষতি হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা কক্সবাজার এর সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ঘুরতে আসে পর্যটকরা। যদি সাগরের পানি নোংরা হয় তবে পর্যটকরা আর কক্সবাজার আসবে না। এতে ক্ষতির মুখে পড়বে পর্যটন ব্যবসায়ীরা। বেকার হবে এ শিল্প ব্যবসার সাথে জড়িতরা। বিষয়টি ব্যবসায়ীদের বুঝতে হবে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- আগে নির্মিত হোটেলগুলোতে এসটিপি স্থাপন নিয়ে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যার কারণে এসটিপি ছাড়া বহুতল ভবন নির্মাণ হয়ে গেছে। এসময় এসে তা অপসারণের সুযোগ নেই। সেন্ট্রাল এসটিপি বসানোর উদ্যোগ নিলে ব্যবসায়ীরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবেন।
হোটেল-মোটেল-গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম বলেন- হোটেল,গেস্ট হাউজগুলো মাত্র ৪/৫ কাঠা জমির উপর নির্মিত। এসব হোটেল ভেঙে এসটিপি বসানোর সুযোগ নেই। এ অবস্থায় একটি সেন্ট্রাল স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হবে।
পর্যটন কর্পোরেশন কক্সবাজার ইউনিট ম্যানেজার মো: রায়হান উদ্দিন বলেন- এসটিপি নিয়ে জেলা প্রশাসনের আলোচনা সভায় আমরা কথা বলেছি। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জমি পাওয়া গেলে কাজ শুরু করা হবে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ নুরুল আবছার বলেন- কক্সবাজারে কয়েকটি হোটেল ছাড়া আর কোন হোটেলে এসটিপি নেই। বিষয়টি দুঃখজনক। এসটিপির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এটিকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা এসটিপির সম্ভাব্যতাও যাচাই করেছি। আশা করছি সকলের সহযোগিতায় দ্রুতই একটি সেন্ট্রাল এসটিপি বাস্তবায়ন করা যাবে।