অ্যাকাডেমিক পড়াশুনা আমাকে কখনোই আকর্ষণ করতো না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষদিন আমাকে একই সঙ্গে দুই ধরনের অনুভুতি দিয়েছিলো। প্রথমত, ক্যাম্পাস ছাড়ার কষ্ট। সেশনজটের কারণে আমি সাত-আট বছর এখানে ছিলাম। ছাত্র আন্দোলনসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অনেক মানুষের সঙ্গে আমার ছিল নিবিড় বন্ধন। যদি কখনও টাইম মেশিন নামক কোনো জিনিসের মালিকানা আমি পাই, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফিরে যাওয়াই থাকবে আমার প্রথম বাসনা।
ক্যাম্পাস ছাড়ার ওইদিনের দ্বিতীয় অনুভুতি ছিলো সুখের। কারণ, আমাকে আর কখনও অ্যাকাডেমিক পড়াশুনার প্যারা সইতে হবে না। আমার স্কুল পালানো শুরু হয়েছিল চতুর্থ শ্রেণী থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কোনো কোর্সে কোনো ক্লাসই কখনও করিনি। এরপরও কেন জানি পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়ে যেতো।
২০০৭ সালের একদিনের এপিসোডের কথা মনে পড়ছে। তখন ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের শাসনামল। জরুরি পরিস্থিতি চলছিল। আমি ছিলাম ছাত্রনেতা। ছাত্র আন্দোলনের উপর নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ধারাবাহিকভাবে বেতন-ফি বাড়াচ্ছিল। এর প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো যৌথ উদ্যোগে জরুরি পরিস্থিতি ভেঙে মিছিল-সমাবেশ করার উদ্যোগ নেয়। আমি যেহেতু সম্মুখসারির আন্দোলন কর্মী ছিলাম, ফলে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আমিসহ আরও কয়েকজনকে নিয়মিতভাবে মনিটরিং করতো। এমন একটি পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে এক বিকেলে ক্লাসরুমে বন্ধুদের দেখে সেখানে ঢুকে যাই। ক্লাস নিচ্ছিলেন খ আলী আর রাজী স্যার। জিজ্ঞেস করলেন, আমি এখানে কেন। বললাম, ক্লাস করতে। আপনার কি এই ক্লাস এনরোলমেন্ট করা আছে? অনেকটা আন্দাজে বললাম, আছে। তারপর তিনি অ্যাটেনডেন্ট খাতা চেক করে দেখলেন, কোর্সটি আমার ছিল। তারপর বললেন, এটি কোর্সের চল্লিশতম ও শেষ ক্লাস। এবং আজকে ক্লাসটিই কোর্সে আমার একমাত্র ক্লাস। এরপর উনি যথার্থই বলেছিলেন, ছাত্র আন্দোলন করার নামে ক্লাস ফাঁকি দেওয়াটা অপরাধ।
কিন্তু, সময় ও পরিস্থিতি বড্ড বৈচিত্র্যপূর্ণ। কেননা, সেই আমাকে পুরোটাই পরিবর্তন হতে হয়েছে। শুরুটা হয়েছিল ২০২০ থেকে, যখন কোভিড শুরু হয়। অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিটের সাংবাদিক হিসেবে লকডাউনের সময় বাসায় বসে আমাদের কাজ করতে হচ্ছিল। অর্থনীতি ছিলে ধ্বসের মুখে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে পলিসিমেকার ও সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদসহ সবাই হিমশিম খাচ্ছিলেন।
লেখালেখির সময় একজন রিপোর্টার অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে কাজ করতে পারেন না। জার্নালিস্টক অবজেকটিভিটিকে আমলে নিলে তাকে এখানে প্যাসিভ থাকতে হয়। ফলে কোভিড সময়কালে রিপোর্ট লেখার উপর কম গুরুত্বারোপ করে অ্যানালাইটিক্যাল কনটেন্ট তৈরির ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করি। অর্থনীতি নিয়ে ওই সময় বিদেশে প্রকাশিত প্রচুর অ্যার্টিক্যাল পড়তে থাকি। সেইসব আইডিয়াগুলো আমার পত্রিকা ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়। ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, বেশকিছু আইডিয়া বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করে এবং প্রজ্ঞাপনও জারি করে।
ওইসব ইস্যু নিয়ে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে কথা বলতাম। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, তারা এসব চিন্তা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। অথবা ক্ষেত্রবিশেষে তারা চেষ্টা করতেন না এর গভীরে প্রবেশ করতে। এদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ড. আহসান এইচ মানসুর। আমার প্রত্যেকটি ইস্যু তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ধরতে পারতেন এবং তাকে সমৃদ্ধ করতেন। তার নিজস্ব চিন্তুাও ছিল। ওইসময় তা নিয়ে আমি লিখেছিলামও।
বাংলাদেশের জ্ঞান জগতের এই শূন্যতা আমার চিন্তার জগতে একাকীত্ব তৈরি করেছিল ভীষণ। তখন মনে হয়েছে কাঠামোবদ্ধ পড়াশুনার বিকল্প নেই। কাঠামোবদ্ধ মানে অ্যাকাডেমিক পড়াশুনাকেই আমি ঈঙ্গিত করছি।
আমি আমার গোটাজীবন ক্লাসরুমের বাইরের পড়াশুনা করতে অভ্যস্থ ছিলাম। এখন আমার ধারণা, নিজের বা আরেকজনের চিন্তুাকে সহজে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অ্যাকাডেমিক পড়াশুনার কোনো বিকল্প নেই।
এই ভাবনা থেকেই ২০২১-এ সিদ্ধান্ত নিই, নতুন করে অ্যাকাডেমিক পড়াশুনায় যুক্ত হওয়ার। নিজেকে তৈরি করার জন্য প্রায় এক-দেড় বছর সময় নিয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে আমি আবেদন করেছিলাম। এর মধ্যে দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে স্কলারশিপ অফার করে। শেষ পর্যন্ত মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিকে আমার আগামী দুই বছরের ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছি। আপাতত নতুন আবাসস্থল মিজৌরি স্টেটের স্প্রিংফিল্ড।
জীবন আসলে বড্ড বৈচিত্র্যপূর্ণ। যে জিনিসটি আমাকে কখনও আকর্ষণ করতো না, সেই অ্যাকাডেমিক পড়াশুনাই আমার এখন জীবন।
৬ আগস্ট আমার যুক্তরাষ্ট্রে আসা। বন্ধু ও শুভকাঙ্খীদের অনেককে আমার স্কলারশিপের বিষয়টি জানাতে পারিনি। আশা করছি, আমাকে ক্ষমা করে আপনাদের শুভকামনার মধ্যে রাখবেন। যুক্তরাষ্ট্রে সেটেল ডাউন করা আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। আমি পড়তে চাই। এবং পড়তে চাই। আমার সহকর্মী ও বন্ধুরা জানেন, পড়ার জন্য আমি কতোটা পাগল! পৃথিবীকে রক্ষার করতে হলে এর বিকল্পও নেই।