পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টিলগ্ন থেকেই বেড়ে ওঠেছে অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক ও এককেন্দ্রীক রাষ্ট্র হিসেবে। এর শাসকবর্গ গোড়া থেকেই ধারবাহিকভাবে স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে রাষ্ট্রদণ্ড হস্তে ধারণ করে। এর প্রতিষ্ঠাতা কিংবা এই রাষ্ট্রের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও ছিলেন অনুরূপ একজন। মনে করা হতো তিনি গণতান্ত্রিক, আদতে তিনি ছিলেন পিতৃতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক। নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাঁর হওয়া উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রী-সেটিই ছিল গণতান্ত্রিক ও শোভন। কিন্তু তিনি তা না হয়ে, হলেন গভর্ণর জেনারেল। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, জিন্নাহ গভর্ণর জেনারেল হোক, এটা আমরা যুবকরা মোটেও চাইনি। তিনি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হবেন, পরে প্রেসিডেন্ট হবেন, এটিই আমরা আশা করছিলাম।
সম্ভবত এই কারণে বাঙালীর স্বাধীন রাষ্ট্রের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিনি নিজের একক প্রচেষ্টায় বাঙালীকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গেছেন, তিনি বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রপতি না হয়ে হলেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ প্রবাসী সরকার গঠনের সময় তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করা হলেও তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে ওই পদ ধারণ করেননি। তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে ফিরে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং প্রেসিডেন্ট না হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সময় পরেও পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী নেতারা কোনো সংবিধান তৈরী করতে পারেননি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করা হলেও মাত্র দেড় বছরের মাথায় ১৯৫৮ সালে গিয়ে সামরিক শাসন জারী করে তা স্থগিত করা হয়। ষড়যন্ত্রের কূটচালে কেটে যায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের দীর্ঘ সময়। অথচ ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের অব্যবহিত পরেই সংবিধান প্রণয়নের দিকে মনোযোগী হন এর প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বল্প সময়ের মধ্যে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে তা কার্যকর করা হয়। বঙ্গবন্ধু এমন একটি গণতান্ত্রিক ও অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে সংবিধান রচনা করেন এবং বাস্তবায়ন করেন যা যেকোনো দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যদিও দ্বিজাতিতত্ত্ব হাজির করে মুসলমানদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তথাপি তিনি নিজে ছিলেন একজন সেক্যুলার ব্যক্তি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর নিজেকে ক্ষমতায় চূড়ায় যখন আবিষ্কার করলেন তখন দেখলেন যে, ধর্মীয় রাষ্ট্র পৃথিবীতে অচল। তখন তিনি পৃথিবীর বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে পাকিস্তানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টিত হন। আর তাই ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী সভায় সভাপতির ভাষণে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন “You are free; you are free to go to your temples, you are free to go to your mosques or to any other place or worship in this state of Pakistan. You may belong to any religion or caste or creed- that has nothing to do with the business of the state.” একই ভাষণে তিনি আরো বলেন, “In course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the state.” তাঁর এই ভাষণ কিন্তু আর দ্বিজাতিতত্ত্বকে ধারণ করেনা। বরং তার সম্পূর্ণ বিপরীত। জিন্নাহ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও সেক্যুলার। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন সেক্যুলার। এ জায়গায় অন্তত দুইজনের মধ্যে মিল পাওয়া যায়। তবে জিন্নাহ পরিবেষ্টিত ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা, পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধারাও ছিলেন প্রায় সবাই অসাম্প্রদায়িক।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের গভর্ণর জেনারেল হওয়ার পর জিন্নাহ যাকে প্রধানমন্ত্রী করলেন, সেই লিয়াকত আলী খানও ছিলেন সাম্প্রদায়িক ও আমলাতান্ত্রিক। গভর্ণর জেনারেল হওয়ার পর জিন্নাহ পাশ্চাত্য ধাচের একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবলেও আশপাশে তিনি কাউকে পাননি। বরং একদল কূপমণ্ডক সাম্প্রদায়িক ও ষড়যন্ত্রবাজ দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। এই নিয়ে তিনি চরম নাখোশ ছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় লিয়াকত আলী খানের সাথে কথোপকথনে। লিয়াকত আলী খান একবার যিয়ারতে অসুস্থ জিন্নাহকে দেখতে গেলে জিন্নাহ রাগান্বিত হয়ে বলেন, “The manners in which you are working sorrounded my Mullahs and Maulvis, The Pakistan of my dreams cannot be created. My Pakistan can only be modern, not medieval. I have made you the Prime Minister for making Pakistan a modern nation. I feel, my decision was wrong.”
এছাড়া মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় তথা নীতি নির্ধারক যারা ছিলেন, তারাও ছিলেন চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ রাজনীতির ধারক ও বাহক। ফলে জিন্নাহ প্রদত্ত অসাম্প্রদায়িক বক্তৃতায় সঙ্গত কারণেই তারা বেজায় নাখোশ হন। তারা বুঝতে পারেন, জিন্নাহ তাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে, অতপর তাদের কাছে জিন্নাহর প্রয়োজনও ফুরিয়ে যায়। আর তাই দেখা যায়, শেষ জীবনে এসে জিন্নাহ পাকিস্তানের নেতাদের কাছে চরম উপেক্ষার শিকার হয়েছিলেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য জিন্নাহ কি অনুশোচনা করেছিলেন? এর জবাব পাওয়া যায় ব্রিটিশ লেখক ও গবেষক অ্যালেক্স ভন টুনজেলম্যান তার লেখা বই Indian summer -এ। এতে উল্লেখ করেছেন যে, লিয়াকত আলী খান জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে গেলে জিন্নাহ বলেন, “Pakistan was the biggest blunder of my life. If I get an opportunity I will go to Delhi and tell Jawaharlal Nehru to forget about the follies of the past and become friends again.” এই ভুলটি জিন্নাহ স্বীকার করলেও ভারতীয় কোনো রাজনীতিক এই সত্যটি স্বীকার করেননি।
তবে ভারত বিভক্তির পর গান্ধীর মনের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করতো এমনটি দেখতে পাওয়া যায় আবুল হাশিমের বয়ানে। তিনি লিখেছেন, “১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হলো। রাজা গোপাল আচারী পশ্চিমবঙ্গের প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হলেন। ১৫ই আগস্টে সকালে গভর্নমেন্ট হাউসে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলো… গান্ধী কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন। বিকেলে সোদপুর আশ্রমে আমি গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। দেবেন দে আমার সঙ্গে ছিলেন। … গান্ধী যথারীতি সাধারণ বেতের মাদুরে বসেছিলেন। দুনিয়া মনে করল দিনটি স্বাধীনতার জন্য গান্ধীর সারাজীবনের সংগ্রামের বিজয়। কিন্তু দীর্ঘ নিঃশ^াস ফেলে তিনি তাঁর গভীর হতাশা প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ‘পৃথিবী জানে সরদার প্যাটেল ‘আমার আজ্ঞাবহ ব্যক্তি’ কিন্তু ইদানীং আমি যা কিছু বলি তিনি তাতেই ‘না’ বলেন। বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রাতভ্রমনে আমার সঙ্গে থাকেন, কিন্তু যখনই আমি আশ্রমে ফিরে আসি আমার মনে হয় যেন আমাদের আর দেখা হবে না। পণ্ডিত জওহারলাল নেহেরু সত্যই জওহার, কিন্তু আবেগ-উচ্ছ্বাসের বশবর্তী হয়ে কখনো কখনো এমন কথাবার্তা বলেন যেটা তাঁর বলা উচিত নয়। কিন্তু তাঁর ভুল যদি তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তিনি তাঁর ভুল স্বীকার করে নেওয়ার সাহস রাখেন। এসব দেখার জন্য আর কতদিন আমি জীবিত থাকব।’ এরপর গান্ধী বেশিদিন জীবিত থাকেননি। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি শুক্রবার মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। অতঃপর আবুল হাশিম উপসংহার টানেন এভাবে, ‘পণ্ডিত জওহারলাল নেহেরু, সরদার প্যাটেল, বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রভৃতি গান্ধীর সহকর্মীরা গান্ধীর আদর্শকে কখনো গ্রহণ করতে পারেননি এবং তাঁরা তাদের উচ্চাকাক্সক্ষা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে নেতা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। একথা গান্ধী খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং এখানেই তাঁর সারা জীবনের যে সংগ্রাম তার পরাজয় হয়েছিল।’
খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল হলেন:
১৯৪৮ সনের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ মারা গেলেন। পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল হলেন পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। খাজা নাজিমুদ্দিন বরাবরই কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের আনুকূল্য পেয়ে কোটারী রাজনীতির সুফল ভোগ করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর প্রতিপক্ষ। মাঠের রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন জনপ্রিয়, প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রমনস্ক। পক্ষান্তরে খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন দক্ষিণপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পূর্বে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বাংলা বিভক্তির সিদ্ধান্ত হলে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পূর্ববাংলার আইনসভার নেতা নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত আইন সভার সদস্যদের ওই নির্বাচনে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের আনুকূল্য পেয়ে খাজা নাজিমউদ্দিন ৭৫-৩৯ ভোটে সোহরাওয়ার্দীকে হারিয়ে সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। এর ফলে খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পূর্ববাংলার প্রথম মন্ত্রীসভা গঠন করেন। এর ফলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ ক্ষমতার রাজনীতিতে ছিটকে পড়ে। তারা সরকারি দল মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে বিরোধী দলে পরিণত হন।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মারা গেলে অনুগত খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। পূর্ব বঙ্গে মূখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন নুরুল আমিন। খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হলেও তিনি জিন্নাহর ক্ষমতা তথা পাকিস্তানের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেননি। এই সময়ে প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। লিয়াকত আলী খান দাপটের সাথে শাসন ক্ষমতা চালাতে থাকেন পক্ষান্তরে ওই সময় খাজা নাজিমুদ্দিন টুটু জগন্নাথে পরিণত হন।
খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হয়ে বরখাস্ত হলেন::
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলী খান ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারালে মন্ত্রীসভা খাজা নাজিমউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদকে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করে। খাজা নাজিমউদ্দিন গভর্নর জেনারেল থাকাকালে লিয়াকত আলী খান যে ক্ষমতা চর্চা করতেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে সে ক্ষমতার নাগাল পেলেন না। প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় গোলাম মোহাম্মদের হাতে। ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ অবৈধভাবে খাজা নাজিমউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলে পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে খাজা নাজিমউদ্দিন পর্দার আড়ালে চলে যান।
পূর্ব বাংলায় নুরুল আমিন অধ্যায়::
খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল হলে পূর্ব বাংলায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন নুরুল আমিন। তিনি ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময়ে সংঘটিত হয় ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষার প্রশ্নে খাজা নাজিমউদ্দিন এবং নুরুল আমিনের অবস্থান ছিল অভীন্ন। তারা নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এবং পাকিস্তানী কায়েমী শাসক গোষ্ঠির মন রক্ষার্থে বাঙালি স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে অবস্থান নেন। এর ফলে বাঙালীদের কাছে তথা পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে তারা ধিকৃত হন। যার ফলাফল দেখা যায় ৫৪ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন::
ভাষা আন্দোলনের উত্থাপের মধ্যে পূর্ববাংলায় ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এই নির্বাচন। এতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল দুটি: মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্ট। এই নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের [সর্বমোট আসন ছিল ৩০৯ টি] মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২১৫ টি, পরে স্বতন্ত্র থেকে ৮ জন যোগ দিলে আসন সংখ্যা হয় ২২৩ টি। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সম্পর্ণভাবে এ নির্বাচনে পরাভূত হয় ; তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত ১ জন মুসলিম লীগে যোগ দিলে তাদের সর্বমোট আসনসংখ্যা দাঁড়ায় ১০-এ। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন: যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করার পর বড় বড় সরকারি আমলাদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার। অনেকে প্রত্যক্ষভাবে মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচার করেছিল। এই সরকারের প্রতি অবাঙালী শিল্পপতিরাও ছিল বিরূপ মনোভাবাপন্ন। এই সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য শুরু হয় বহুমুখী ষড়যন্ত্র।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় আওয়ামী লীগ দলীয় মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণের দিন ঘটে আদমজী জুটমিলের দাঙ্গা। এ প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন:
শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পরেই আমরা খবর পাইলাম আদমজী জুটমিলে শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা হইয়াছে। হক সাহেবের নেতৃত্বে আমরা সব মন্ত্রীরাই ঘটনাস্থলে গেলাম। স্তম্ভিত হইলাম। শতশত মৃতদৃহ ডিঙ্গাইয়া আমাদের পথ চলিতে হইল। এমন নৃশংস হত্যকাণ্ড ১৯৪৬ সাল হইতে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কলিকাতার বিভিন্ন দাঙ্গায়ও দেখি নাই। পরবর্তী কয়েক রাত আমি ঘুমাইতে পারি নাই।
আদমজীর দাঙ্গা সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান যা লিখেছেন তাতে বুঝা যায়, যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কী সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেছিল। তিনি লিখেছেন:
সামান্য একটি ঘটনা নিয়ে দাঙ্গার শুরু। … দাঙ্গা করে পাঁচশত লোকের অধিক মারা যায়। পুলিশ কর্মচারীরা পূর্বেই খবর পেয়েছিল, তবু কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই…।
এই দাঙ্গা যে, যুক্তফ্রন্টকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এবং দুনিয়াকে নতুন সরকারের অক্ষমতা দেখাবার জন্য বিরাট এক ষড়যন্ত্রের অংশ সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই। কয়েকদিন পূর্বে এই ষড়যন্ত্র করাচী থেকে করা হয়েছিল। মিলের কোন কোন কর্মচারী এতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যে সুযোগের সন্ধানে ছিল, এই দাঙ্গায় তা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
যুক্তফ্রন্টের পতন::
২১ মে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক কালাহানকে মূখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বলেন, এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘পূর্ব বাংলার অধিক স্বায়াত্তশাসন পাওয়া উচিত।’ কালাহান মূখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করে প্রচার করে। এরপর ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ফজলুল হকের বিরুদ্ধে ‘জাতীয় বিশ^াসঘাতকতা’র অভিযোগ তুলে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে দিয়ে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা জারীর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসন তথা গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করেন। খালেকুজ্জামানকে অপসারণ করে পূর্ববঙ্গের গভর্ণর হয়ে আসেন সেই সময়ের প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইসকান্দর মীর্জা। পাকিস্তানের সংসদীয় রীতি অনুসারে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক সরকার তথা যুক্তফ্রন্ট সরকার মাত্র ১ মাস ২৭ দিন আয়ূ পেয়ে ক্ষমতার মসনদ থেকে ছিটকে গেলে বাঙালী মনে বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়।
গোলাম মোহাম্মদ বনাম মোহাম্মদ আলী:
মোহাম্মদ আলী সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের সাথে তাঁর দূরত্ব তৈরী হয়। ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ববাংলার সাংসদরা সিন্ধুর সাংসদদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব করে একটি বিল পাশ করে। এই বিলটি আইনে পরিণত হলে গভর্নর জেনারেল নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান হতেন। এতে গোলাম মোহাম্মদ ক্ষুব্ধ হয়ে গণপরিষদ ভেঙ্গে দেন এবং জরুরী অবস্থা জারী করেন। গভর্নর জেনারেলের এই আদেশের বিরুদ্ধে পরিষদের সভাপতি তমিজউদ্দিন সিন্ধুর হাইকোর্টে মামলা করলে হাইকোর্ট গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলে সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্টের রায়কে নাকচ করে দিয়ে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠনের নির্দেশ প্রদান করেন।
প্রথম গণপরিষদে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। কিন্তু প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ভোটে যে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়, তাতে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। কারণ ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ব্যাপক বিপর্যয় এবং যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ে দ্বিতীয় গণপরিষদে ৮০টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগের সংখ্যা হয় ৩৩টি। দ্বিতীয় গণপরিষদে পূর্ববাংলা থেকে ৩৯জন সদস্য নির্বাচিত হন। তন্মধ্যে যুক্তফ্রন্ট-২৮, কংগ্রেস-৪, তফশীলী ফেডারেশন-৩ ও অন্যান্য-৪। মুসলিম লীগ থেকে নির্বাচিত হন ১জন। তিনি বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। যুক্তফ্রন্টের শরীক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে নির্বাচিত হন ১২জন। তন্মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন।
১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই পকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদের অধিবেশন বসে মারীতে। এই অধিবেশনে মুসলিম লীগ চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা মনোনীত করলে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে হয়। তদস্থলে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গণপরিষদে পাশ করে, যা একই বছরের ২৩ জুন কার্যকর হয়।
গোলাম মোহাম্মদের বিদায়
ইসাকন্দর মীর্জার আগমন::
১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অসুস্থতাজনিত কারণে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পদত্যাগ করলে ইসকান্দর মীর্জা নতুন গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। নতুন সংবিধানে গভর্নর জেনারেল পদবি পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট করা হয়। ফলে ইসকান্দর মীর্জা হন পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট। ইসকান্দর মীর্জা নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার লক্ষ্যে ২৮ মে ১৯৫৬ সালে রিপাবলিকান পার্টি নামে একটি নতুন পার্টি গঠন করেন। মুসলিম লীগের অধিকাংশ সদস্য এই দলে যোগদান করেন। ফলে এই সময়ে মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা ১০-এ নেমে আসে। অপরদিকে রিপাবলিকান পার্টির সদস্য সংখ্যা ২৬-এ উন্নীত হয়। রিপাবলিকান পার্টির সদস্যগণ আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন:
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সোহরওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের সমর্থক ও সংরক্ষক। পকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সোহরাওয়ার্দী চলে যান পশ্চিম বঙ্গ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি জিন্নাহর নেতৃত্বের প্রতি এতটাই অভিভূত ছিলেন যে, জিন্নাহর নির্দেশেই তিনি লাহোর প্রস্তাবের ক্ষতিকর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যার ফলে পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীতে জিন্নাহর আনুকূল্য পেয়েছেন, এমনটি দেখা যায় না। যদিও তিনি ৪৭-এ অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও হিন্দুদের সমর্থন না পাওয়ায় এর সফলতা তিনি পাননি, তথাপি লাহোর প্রস্তাব সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপক হিসেবে এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না। যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে গেছেন, দেখা গেলো সেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁর জন্য খুব বেশি জায়গা অবশিষ্ট নেই। নবগঠিত পাকিস্তানে তিনি লাঞ্চিত হয়েছেন, কারন্তরীণ হয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত অকাল মৃত্যুর শিকার হয়েছেন।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক গণ-পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন গণ-পরিষদ গঠনের সময়ে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে গণ পরিষেদের সদস্য সংখ্যায় প্যারিটি প্রবর্তন করা হয়। পূর্ব বাংলার কাছে যা ছিল অগ্রহণযোগ্য। পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা অধিক হওয়ায় এক ব্যক্তি এক ভোট পদ্ধতি অনুসরণে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধির সংখ্যা বেশি হবে এ ধারণা স্পষ্ট ছিল। এ কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী ও খাজা নাজিমউদ্দিনদের দেয়া শাসনতন্ত্র আওয়ামী লীগ প্রত্যাখান করে আসছিল। কিন্তু সোহরওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর সেই অগণতান্ত্রিক প্যারিটির পক্ষে কথা বলা শুরু করলেন। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, গণ পরিষদে প্যারিটি মেনে নেয়া হলে, চাকুরী থেকে শুরু করে সর্বত্রই পাকিস্তানের দুই অংশে সমতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে স্পষ্টতই দ্বিমত পোষণ করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘জিন্নাহ সাহেব পর্যন্ত আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেনে নিয়েছিলেন, আর আজ আমাদের তা বিসর্জন দিতে হলো শুধুমাত্র নেতার জন্য।’ সোহরাওয়ার্দীর কিছু কিছু বক্তব্য (যা তাঁর ক্ষমতাকে মসৃণ করার জন্য হতে পারে) পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির চিন্তার সম্পূরক এবং পূর্ববাংলার স্বার্থের প্রতিকূল হলেও তিনি খাজা নাজিমউদ্দিনের মতো সমালোচিত হননি। কারণ প্রথমত: তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, দ্বিতীয়ত: বঙ্গবন্ধু তাঁকে নেতা মানতেন। তবে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সবসময় তাঁর সাথে একাত্মতা পোষণ করতেন এমনটিও নয়। বরং প্যারিটি প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সংক্ষুব্ধ হয়ে সোহরওয়ার্দীর বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পতন চুন্দ্রীগড়ের আগমন:
ইসকান্দর মীর্জা ছিলেন নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ও প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারের পক্ষে, পক্ষান্তরে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের প্রবক্তা। সহসা ইসকান্দর মীর্জা ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বের জেরে ১৮ অক্টোবর ১৯৫৭্ সালে সোহরাওয়ার্দী পদচ্যুত হন।
এরপর মুসলিম লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে আই. আই চুন্দ্রীগড় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় থাকলে মুসলিম লীগ শক্তিশালী হতে পারে এই আশংকায় রিপালিকান পার্টি মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে ফের আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন করে মন্ত্রীসভা গঠন করে।
ইসকান্দর মীর্জার পতন, আইয়ুবের আগমন :
নতুন মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন রিপাবলিকান পার্টির ফিরোজ খান নুন। ইসকান্দর মীর্জার সাথেও ফিরোজ খান নুন বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এই টানাপোড়েনের মধ্যে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নিজের প্রেসিডেন্ট পদ ধরে রাখা সম্ভব হবে না- এই আশংকায় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে ইসকান্দর মীর্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারী করেন। এর ফলে নুন মন্ত্রীসভার পতন ঘটে এবং পাকিস্তানে সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে। ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ইসকান্দর মীর্জাকে উৎখাত করে নিজে প্রেসিডেন্ট হন এবং মীর্জাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন। আইয়ুব খান ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ সাল থেকে ৮ জুন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং ৮ জুন ১৯৬২ সাল থেকে ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বেসামরিক শাসক হিসেবে পাকিস্তান শাসন করেন।
ক্ষমতাসীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান অচিরেই তার মুখোশ উন্মোচন করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর আইয়ুব খান মন্তব্য করেছিলেন, “আমাদের বুঝতে হবে যে, উষ্ণ আবহাওয়ায় গণতন্ত্র কার্যকর নয়, গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন বৃটেনের মত ঠাণ্ডা আবহাওয়া।” তিনি ধর্মকে পাকিস্তান জাতি গঠনের প্রধান অবলম্বন হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন। আইয়ুব খানের বিরোধীতা করার জন্য ১৯৬৪ সালের শুরু থেকেই বিরোধী দলগুলো ঐক্যফ্রন্ট জাতীয় কিছু একটা করার চেষ্টা করে। এর ফলে ১৯৬৪ সালের অক্টোবর নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটার মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচনের আগেই কাউন্সিল মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংযুক্ত বিরোধী দল (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিজ-(কপ) গঠন করে। যখন কপ গঠিত হয় তখন বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যেকার মতবিরোধ স্বীকার করার বদলে তা এড়িয়ে যান। … কপের বড় সাফল্য হলো, আইয়ুবের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী হতে রাজী করানো। পকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছোট বোন ফাতেমা জিন্নাহর প্রতি জনগণের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য তিনি যেখানে গেছেন সেখানেই অভূতপূর্ব সমর্থন লাভ করেন। কিন্তু আমলাতন্ত্র এবং পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টা আইয়ুবকে নির্বাচনে জিতিয়ে দেয়। এত কিছুর পরেও ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি, শনিবার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৬ ভাগ মৌলিক গণতন্ত্রী ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দেয়।
এ অবস্থায় আইয়ুবের প্রতিক্রিয়াশীলতাকে রুখতে রাজনীতিকদের এগিয়ে আসা উচিৎ ছিল। কিন্তু সামরিক আইনের নিষেধাজ্ঞা ও বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ এবং অযোগ্যকরণ আইন-অধ্যাদেশ, যেমন- ঊইউঙ, চঙউঙ ইত্যাদি রাজনীতিবিদদের উপর খড়গ হিসেবে কাজ করে। তার উপর প্রতিনিয়ত গ্রেফতার ও কারাবাসের ফলে রাজনীতিক্ষেত্রে এক বিরাট শূণ্যতা সৃষ্টি হয়। এ শূন্যতার সুযোগে সামরিক স্বৈরাচার তাঁর কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হয়।
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা প্রদান:
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক চেতনা ও আন্দোলনের ধারা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। পাক-ভারত যুদ্ধোত্তর পটভূমিতে সামগ্রীক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানসহ পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু প্রভাবশালী বিরোধী দলীয় নেতা ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানের উভয় অংশের বিরোধী দলের নেতাদের এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের দাবিগুলো তুলে ধরার সুযোগ লাভের আশায় লাহোর কনফারেন্সে যোগ দেন। এ সময়েই শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার খসড়া প্রস্তুত করেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা নিয়ে তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর যান এবং পরদিন সাবজেক্ট কমিটির মিটিংয়ে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি হিসেবে ‘ছয় দফা’ পেশ করেন। কিন্তু লাহোর কনফারেন্স ছিল আসলে একটি ভারতবিরোধী সাম্প্রদায়িক সমাবেশ, যার মূল লক্ষ্য ছিল কাশ্মির ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করা। তাই তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর সাবজেক্ট কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু ৬দফা দাবী পেশ করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ‘ছয় দফা দাবি’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয় দফার বিকৃত বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। ফলে তিনি ৬ ফেব্রুয়ারির মূল কনফারেন্সে যোগ না দিয়ে কয়েক দিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরেন। তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের নিকট তাঁর ৬ দফা তুলে ধরেন ।
এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি’৬৬ বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমণ্ডিস্থ ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, দলের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং জেলা কমিটির সভাপতি/ সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে এক বর্ধিত সভা করেন। সভায় ১৫ ঘন্টাব্যাপী আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধুর ‘ছয় দফা’-কে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এছাড়া এই সভায় ১৮-২০ মার্চ তিনদিন ব্যাপী দলের কাউন্সিল অধিবেশন করার সিদ্ধান্ত হয়। কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচিকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এটি ছিল পাকিস্তানী রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একটা ঘটনা। ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক জনতার এক বিরাট সমাবেশে ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘ক’ ধারা বলে তাঁকেসহ তাঁর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। ‘ছয় দফা’ দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে দেশরক্ষা আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেফতার-নির্যাতন চালায়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের:
বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েও ‘ছয় দফা’ আন্দোলনকে যখন রোধ করা যাচ্ছিল না, তখন তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে চিরতরে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য আইয়ুব খান ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা দেন। যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে পরিচিত।
মামলা দায়েরের পেছনে আইয়ুব খানের হয়ত উদ্দেশ্য ছিল, শেখ মুজিবকে জনগণের কাছে ভারতীয় চর ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে; এতে করে জনসমর্থন সরকারের পক্ষে যাবে এবং শেখ মুজিবকে কঠোর সাজা দেয়া সহজতর হবে। কিন্তু এতে করে দেশবাসীর কাছে সরকারের এ ষড়যন্ত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সরকারি এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সকল বন্দির মুক্তির দাবিতে যুগপৎ গণআন্দোলন গড়ে তোলেন।
ফয়েজ আহমদ লিখেছেন, বিচারের সময় সেনানিবাসের সিগন্যাল অফিসার্স মেসে তেরোজনের সাথে বন্দি ছিলেন এক নম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তি আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান; তাঁকে সেখানে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার সময় ক্যাম্পের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে শেখ সাহেব প্রহরাধীন অবস্থায় পায়চারী করছিলেন। সে সময় একজন পাঠান- ক্যাপ্টেন শেখ মুজিবকে ত্বরিত নিজ কক্ষে চলে যাবার জন্য গোপনে জানিয়ে যান। শেখ সাহেব তাঁর কক্ষে চলে যান। কথাটি বন্দিশালায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে সেই রাতে কিছু ঘটেনি। কিন্তু চরম নৃশংস ঘটনা ঘটে পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে ছ’টার দিকে। শেখ সাহেবের এলাকা থেকে দূরবর্তী থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টারে বন্দি ছিলেন অপর বাইশজন অভিযুক্ত ব্যক্তি। সেদিন ভোরে গার্ডের অনুমতি নিয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হক (১৭ নম্বর অভিযুক্ত) ও ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহম্মদ ফজলুল হক (১১ নং অভিযুক্ত) তাঁদের নির্দিষ্ট কক্ষের বাইরে টয়লেটে যাবার জন্য বের হন। মাত্র ছয়-আট ফুট দূর থেকে একজন গার্ড, সম্ভবত আগে থেকেই সে প্রস্তুত ছিল, তাঁদের মুখোমুখি গুলি করতে শুরু করে। … গুলি বেয়নেট চার্জের পর মৃত মনে করে এক ঘন্টা পর এ দু’জনকে সি.এম.এইচ-এ নিয়ে যাওয়া হয়। … এ দু’জনকে ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশেষ কোনো নির্দেশে হাবিলদার মঞ্জুর হোসেন শাহ্ হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেছিল।
এ হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুদ্ধ জনতা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও অন্যান্য ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। জনতা রাস্তায় নেমে আসে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহর যেন বিক্ষোভে জ¦লছিল। বিচারপতি এস এ রহমানের বাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়া হয়। কার্ফ্যু জারি করা হয়। ঢাকা শহর হয়ে ওঠে বিক্ষোভের শহর। পুরো রাজপথ শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে উত্তাল। বাস্তবে ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে পুরো ঢাকা শহরই মশাল মিছিলে যোগ দেয়। ২১ ফেব্রুয়ারিও ঢাকার জনগণ রাস্তায় ছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দেয়া হয়।’
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি প্রদান:
প্রবল চাপ ও আন্দোলনের উত্তাপে ১৭ ফ্রেবুয়ারি আইয়ুব খান জরুরী অবস্থা ও পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইন প্রত্যাহার করে নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল আসামীকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জনগণের চাপে আব্বাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল। সেদিন এই বাড়ির সামনে মানুষের ঢল নেমেছিল। সমস্ত বাড়িই যেন জনতার দখলে চলে যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে।’ ওইদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, ‘হাজার হাজার মানুষের মতো আমিও তাঁর ধানমন্ডির বাড়ির দিকে দৌঁড়ে গেলাম। কিন্তু জনতার এত ভিড় ছিল যে আমি খুব বেশি অগ্রসর হতে পারিনি। বাড়ি ফিরে আমি ডায়েরিতে লিখলাম যে, শেখ মুজিব মানে হচ্ছে জনতা, সুতরাং আমি জনতাকে দেখে এলাম।’
গণআন্দোলেনের উত্তাপে আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিবসহ সকল বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলায় অভিযুক্তদের এক গণসম্বর্ধনা দেয়া হয়। সভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হওয়ার ঘটনা ছিল বড় পরাজয়। স্মর্তব্য যে, ১৯৬২-৬৬ সাল পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ৭৭টি মামলা দায়ের করে।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুবের পতনের পর পাকিস্তানের শাসনদণ্ড ধারণ করেন সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। তাঁর সময়ে ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে। শুরু হয় নানা টানাপোড়েন। এই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানী শাসনের অবসান ঘটে। অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।