রক্তের টানে বছরে কয়েক বার যাওয়া হয় পার্বত্য বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায়। ওখানে থাকে আমার বড় বোন।
গাছপালা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, পাখির কিচিরমিচির শব্দ, ছোট ছোট পাহাড়ী ঝিরি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক জীবন যাপন ইত্যাদি অনেক ভালো লাগে, আমাকে রীতিমত মুগ্ধ করে। ওখানে গেলে বিকেল বেলায় কিশোর দুই ভাগ্নে আদনান ও আদরকে নিয়ে আশেপাশে ঘুরতে বের হই।
ভাগ্নেদের বাড়ির অদূরে গড়ে উঠেছে খ্রিষ্টান পল্লী। এই পল্লীর অধিবাসীরা সাদা চামড়ার যেমন নয় তেমনি ইউরোপ আমেরিকা থেকে এসেও এখানে বসতি স্থাপন করেনি। এরা আমাদের দারিদ্র্য পীড়িত মগ, মুরুং, চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা, তঞ্চৈগ্যাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক। খ্রিষ্টান মিশনারি নগদ অর্থের লোভ, চাকরির প্রলোভন, উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতিসহ আরো অনেক কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে। মিশনারিরা শ্রেফ ওই গোষ্ঠীর দারিদ্র্যতাকে কাজে লাগিয়েছে।
ইতিহাস পড়ে অল্প বিস্তর জেনেছি এই ধরনের মিশনারিদের উদ্দেশ্য শুভ নয়। এজন্য এত ভালো লাগার মাঝেও এক প্রকার ভয় কাজ করে। এখানে আসলে একজন মানুষের কথা আমার খুবই মনে পড়ে।
কোন কোন মানুষ আলস্যে সমগ্র জীবন পার করে দেয়, কোন কোন মানুষ জীবনে কিছু সময়ের জন্য সংগ্রাম করে, আবার কোন কোন মানুষের পুরো জীবনটাই হয় সংগ্রামের। এই চির সংগ্রামীদের একজন হলো ভিয়েতনামের প্রাণপুরুষ হো চি মিন। হো মাত্র ১৮ বছর বয়সে মাতৃভূমি ভিয়েতনামকে ফরাসী দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তির আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সুদীর্ঘ ৬২ বছর ব্যয় করেছেন।
যে কারণে হো চি মিনকে মনে পড়ে- এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম ভিয়েতনামের প্রাণপুরুষ হো চি মিন’র। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি ছিল প্রচন্ড আগ্রহ। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর মাধ্যমিক শিক্ষার জন্যে হো’র গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে বাবা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন শহরের একটি স্কুলে। এই প্রথম হো নিজ গ্রামের বাইরে গেলেন। এতদিন জানতেন ভিয়েতনামীরা স্বাধীন কিন্তু শহরে এসে দেখলেন আসলেই তারা পরাধীন। তাদের দেশে তাদেরকে শাসন করছে বিদেশি ফরাসিরা। নিজ দেশেই তারা পরবাসী। মাতৃভূমিতে তাদের কোন অধিকার নেই। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ভিয়েতনাম কিন্তু সেই সম্পদ তারা ভোগ করতে পারে না। অনাহারে অর্ধাহারে থাকা তার দেশের মানুষগুলো দেখতে রোগা কিন্তু ফরাসী ওই ছাড়পোকাগুলো তাদের রক্ত খেয়ে মোটাতাজা।
স্কুলের সমস্ত শিক্ষক ভিয়েতনামি হলেও প্রধান শিক্ষক ছিলেন ফরাসি। তিনি ছিলেন একজন স্বেচ্ছাচারী। কারো সাথে কোন পরামর্শ না করে নিজের ইচ্ছামত স্কুল চালাতেন। তার বিরুদ্ধে কোন কিছু বলার অধিকার কারও নেই। শুধু তাই নয়। ফরাসি ও ভিয়েতনামি ছাত্রদের মধ্যেও তিনি বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন। একদিন ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিলেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রধান শিক্ষক ক্লাশে ঢুকলেন। ফরাসি ছাত্ররা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন আর ভিয়েতনামীরা না দাঁড়িয়ে বসে রইলেন।
রাগে ফেটে উঠলেন প্রধান শিক্ষক। ভিয়েতনামীরা এত সাহস পায় কোথায়! সিদ্ধান্ত নিলেন কিছু ছাত্রকে স্কুল থেকে বের করে দেবেন। অপমানে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন। প্রধান শিক্ষক ভাবলেন হো গ্রামের সহজ-সরল মেধাবী ছেলে। তার কাছ থেকে আসল ব্যাপার জানা যাবে। প্রধান শিক্ষক হো চি মিনকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন কাদের প্ররোচনায় তোমরা আমাকে অপমান করেছো? হো চুপ করে রইলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন। আগের মতই মাথা নিচু করে হো দাঁড়িয়ে রইলেন। চিৎকার করে প্রধান শিক্ষক বললেন কেন তোমরা আমাকে অপমান করেছো? হো দৃঢ় কণ্ঠে বললেন- আপনি প্রধান শিক্ষক হয়েও ভিয়েতনামী ছাত্রদের সাথে অন্যায় আচরণ করেন, আমরা শুধু তার প্রতিবাদ করেছি। এই কথা বলার সাথে সাথে প্রধান শিক্ষক সামনে টেবিলের উপর রক্ষিত বেতগুলো দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করলেন হো’র পিঠ। সেদিন সিদ্ধান্ত নিলেন মাতৃভূমিকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবেন।
তার আগে জানতে হবে দেশের পৃথক ইতিহাস। দেশের ইতিহাস জানতে গিয়ে খুঁজে পেলেন আসল ঘটনা-
আঠারশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফরাসি খ্রিষ্টান মিশনারি ভিয়েতনামে এসেছিল ধর্ম প্রচার করতে। তখন সম্রাট ছিল মিং মাং। তিনি তাদের এই আগমনকে পছন্দ করেননি। তাই তিনি ওই ধর্ম প্রচারক দলকে থাকার অনুমতিও দেননি। ধর্ম প্রচারক দলের অনেক আকুতি-মিনতি পর একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকতে অনুমতি দিলেন। শুরুতে কয়েক বছর মিশনারিদল নিজেরা ধর্ম চর্চা করে কাটিয়ে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে নিজেদের প্রকৃত চেহারা প্রকাশ করতে লাগলো। তারা আশেপাশের ভিয়েতনামিদের মধ্যে ধর্ম প্রচার শুরু করলো। বিশেষ করে গরিব শ্রেণীকে অর্থসাহায্য দিয়ে খ্রিস্টান ধর্মের দিকে টানতে লাগলো। অর্থের প্রলোভনে পড়ে অনাহারে অর্ধাহারে থাকা গরিব মানুষগুলোর ধর্মান্তরিত হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগলো। শুনে সম্রাট মিং মাং ক্ষুব্ধ হলেন এবং তারা সাময়িক ধর্ম প্রচার বন্ধ রাখলেও পরবর্তীতে পুরোদমে আবারো ধর্ম প্রচার চালিয়ে যেতে লাগলো।
দেশের অনেক স্হানে স্হাপিত হলো নতুন নতুন উপাসনালয়। ফরাসি নতুন নতুন ধর্ম প্রচারকের দল এসে ভিড় করতে লাগলো ভিয়েতনামে প্রতিষ্ঠিত উপাসনালয়গুলোতে। এসব দেখে শুধু সম্রাট নয় স্হানীয়রাও উত্তেজিত হলো, খ্রিষ্টান ধর্ম যাজকদের উপর। ক্ষুব্ধ জনতার আক্রমনের স্বীকার হয়ে মারা পড়ল অনেক ধর্ম যাজক এবং অনেকে পালিয়ে গেল ফ্রান্সে।
ঔপনিবেশিক ফরাসি সম্রাট এর প্রতিশোধ নিতে বিশাল সৈন্যবহর পাঠালেন ভিয়েতনামে। ভিয়েতনাম সম্রাট বাঁধা দিয়েও পরাস্হ হলেন এবং ফরাসিরা দখল করলো সায়গন নামক অঞ্চলটি। এই এলাকাটিকে তাদের ঘাঁটি বানালো। দীর্ঘ বিশ বছর যাবৎ ফরাসিরা এই অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে আশেপাশের আরো কয়েকটি অঞ্চল নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে পুরো ভিয়েতনাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। নিজ দেশে ভিয়েতনামীরা হলো প্রবাসী। স্বাধীনতা হারিয়ে যারা প্রতিবাদ করেছে তাদেরকে গুলি ছুড়ে হত্যা করেছে, জেলে পুরেছে, নেমে এসেছে নির্যাতনের স্ট্রীমরোলার। ফরাসী সৈনিকদের লালসার স্বীকার হয়েছে অসংখ্য ভিয়েতনামী মা ,বোন। অফিস আদালতে যাবতীয় উচ্চ পর্যায়ে বসানো হলো ফরাসী নাগরিকদের। ফরাসীদের পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম নিল ভিয়েতনামী এক শ্রেণীর রাজাকার বা তাঁবেদার দল। এসবের উদ্দেশ্য শুধু একটাই আর তা হলো ভিয়েতনামের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করা। দীর্ঘ ৮০ বছর ফরাসী ঔপনিবেশিক দল ভিয়েতনামের প্রাকৃতিক সম্পদ ও দেশের জনগণের রক্ত মাংস চুষে খেয়েছে। পরবর্তীতে হো’র নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনের মুখে ফরাসী ঔপনিবেশিক দল টিকতে না পারলে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে যুক্তরাজ্য।
সবশেষে আমেরিকাও এগিয়ে আসে। আর ভিয়েতনামের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে চীন ও রাশিয়া। অবশেষে দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধের পর বীরের জাতি ভিয়েতনামীরা দীর্ঘ ৮০ বছরের গোলামীর শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসে।
এই দেশ আমাদের সকলের, সকল ধর্মালম্বীদের। আমি সকলের শান্তিপূর্ণ অবস্থান ও নিজনিজ ধর্ম চর্চায় বিশ্বাসী। আমার বোনের বাড়ির অতি নিকটেই খ্রিষ্টান পল্লী। খ্রিষ্টান মিশনারিরা গরীব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও অন্যান্য সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করে এখানে বসতি স্থাপন করে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এরকম শতশত মিশনারি কাজ করছে। এখানে আসলে আমার বারবার মনে পড়ে ভিয়েতনামীদের কথা, হো চি মিন’র কথা। এখানে আসলে আমার সময় কাটে এক অনিশ্চিত আশংকার মধ্যে দিয়ে।
উল্লেখ্য আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এই মিশনারিদের উদ্দেশ্য এই সম্পদ কিনা তা আমি জানি না। কোন কোন সুহৃদ আমাকে পুঁটি মাছের প্রাণ ভাবতে পারেন, ধর্মীয় গোঁড়ামি ভাবতে পারেন, বলতে পারেন আমি মনের দিক দিয়ে দরিদ্র। আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন কিন্তু আমি ভাবি ( মনে করি) সবার উপর আমার দেশ।