ভ্রমণের নেশা আমার আজন্ম। সময় সুযোগ পেলেই দেশে-বিদেশে ভ্রমণে বের হওয়া আমার সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
অনেক জায়গায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যাওয়া হয়নি।সেই আপসোস আমার সব সময়। এবারও ঢাকায় ছেলেকে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে এসে যতটুকু সময় বের করে নিতে পেরেছি,ততটুকু সময়কে কাজে লাগিয়েছি।
এ পর্যায়ে মূলত ওর মধ্যে ভ্রমণপিপাসু চেতনা জাগ্রত করার জন্য আবারও ঘুরে এলাম একে একে ঢাকার ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল,পদ্মা সেতু, জাতির পিতার সমাধি, ষাটগম্বুজ মসজিদ ও ঢাকেশ্বরী মন্দির ইত্যাদি। আজকের পোস্টে ষাটগম্বুজ মসজিদ এর ভ্রমণকাহিনীর বিবরণ দেবো।
৩০ জুলাই, ২০২২ জাতির পিতার সমাধি পরিদর্শন বেলা ১২ঃ৩০ টার মধ্যে শেষ করলাম। কাল কলেজ বন্ধ।আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার কিংবা থাকার পূর্ব প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিলাম, টুঙ্গিপাড়া থেকে এক দেড় ঘন্টার রাস্তা বাগেরহাট।ছেলেটিকে এ যাত্রায় ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখাবো।
জাতির পিতার সমাধি কমপ্লেক্সের ২নং গেটের ক্যান্টিনে ঢুকে পড়লাম। দুপুরের খাবারের অর্ডার দিলাম। রুই মাছ / মুরগী, তিত করলের ভাজি,ডাল দিয়ে তৃপ্তিসহকারে ভাত খেলাম।বিল এলো দু’জনের মাত্র ৪০০/-টাকা। অতঃপর ফোন দিলাম চট্টগ্রামে গণপূর্তের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ১৫ শ বিসিএস ব্যাচের আমার বন্ধু আবুল খায়েরকে।সে দ্রুত কলব্যাক করে জানালো,বাগেরহাট গণপূর্ত কার্যালয়ের রেস্টহাউজে রাত যাপন করা যাবে।
তার এ প্রতিশ্রুতি পেয়ে এখান থেকে দ্রুত ভ্যানগাড়িতে চড়ে পাটগাতী পয়েন্টে চলে এলাম।এবার মাহেন্দ্রতে চড়ে গোপালগঞ্জের ঘোনারপাড়ায় নামলাম।
এখান থেকে লোকাল বাসে বাগেরহাটের নোয়াপাড়া পয়েন্টে নেমে পড়লাম।এখানে তরতাজা ডাবের পানি পান করলাম তৃপ্তিভরে।কিছুক্ষণের মধ্যে ষাটগম্বুজের উদ্দেশ্য আরও একটি লোকাল বাসে উঠে গেলাম।২০/২৫ মিনিটের মধ্যে গাড়ি খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক সংলগ্ন ষাটগম্বুজের পাশে আমাদের নামিয়ে দিলো।
দেরি না করে টিকেট কাউন্টারে গিয়ে জনপ্রতি ২০/-মূল্যের টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম ষাটগম্বুজ মসজিদ কমপ্লেক্সে।তখন বিকেল ৩ঃ০০টা।আমাদের প্রচণ্ড ভ্রমণক্লান্তি।চোখে মুখে ঘুমের ঘোর।কমপ্লেক্সে ঢুকতে বাগেরহাট জাদুঘর পরিদর্শনে গেলাম প্রথমে।
জাদুঘরের সরকারি গাইড আমাদের স্বল্প সময়েএখানে সংরক্ষিত উপাদান দেখালেন।সাথে প্রত্যেকটি আইটেমের যতটুকু সম্ভব চমৎকার বিবরণ দিলেন।
এদিকে ছেলেটির অবস্থা তখন ত্রাহি ত্রাহি। তার অবস্থা দেখে জাদুঘরে কর্মরত অফিস সহায়কের সহযোগিতা চাইলাম।তিনি আমাকে জাদুঘরের কাস্টোডিয়ানের ফোন নং দিয়ে যোগাযোগ করতে বললেন।
সেই মোতাবেক আমি উনাকে ফোনে আমার নাম পরিচয় দিয়ে জাদুঘরের রেস্টহাউজে বিশ্রামের ব্যবস্থার অনুরোধ জানালে উনি ইতিবাচক সাড়া দিলেন।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।তা নাহলে শ্রাবণের এই কাঠফাটা রোদে ষাটগম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন পর্ব নিরানন্দ থেকেই যেত।
যাহোক,রেস্টহাউজের ব্যবস্থাপনাও চমৎকার।এসি রুমে ঘন্টাখানেক
রেস্ট নেওয়ার পর কেয়ারটেকারের পরিবেশনায় চা পানে আমাদের ভ্রমণক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে যায়।জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
বেলা৪ঃ৪৫ দিকে আমরা ষাটগম্বুজ মসজিদ পরিদর্শনে গেলাম।এখানে আমি আগেও এসেছি।এবার ছেলেকে চক্ষু মেলিয়া মসজিদ দেখালাম।তার জ্ঞতার্থে নিম্নোক্ত বর্ণনা দিলাম।
পঞ্চদশ শতকে খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলে সুলতানী আমলের মুসলিম শাসক ও সেনাপতি ছিলেন খান জাহান আলী।ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন সাাধু পুরুষও ছিলেন।তিনিএই জনপদের
গোড়াপত্তনকালে মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও শিল্প
-সৌন্দর্যমণ্ডিত এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।কথিত আছে,তিনি এই জনপদে এটিসহ ৩৬০ টি মসজিদ ও ৩৬০টি দিঘি খনন করেন।তাঁর এই কীর্তিচিহ্ন এই জনপদে আজও ছড়িয়ে আছে। তারমধ্যে ষাটগম্বুজ মসজিদ এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। ১৯৮৫ খ্রি. ইউনেস্কো এ স্বীকৃতি প্রদান করে।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভেতরের দিকে ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমের বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভেতরের দিকে ৮৮ ফুট চওড়া।দেয়াল প্রায় ৮.৫ ফুট পুরু।মসজিদের গম্বুজের সংখ্যা মোট ৮১ টি,সাত লাইনে ১১টি করে ৭৭টি এবং চার কোনায় ৪টি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মতে,মসজিদের ছাদ আড়াআড়িভাবে এগারোটা এবং লম্বালম্বিভাবে সাতটি সারিতে বিভক্ত হওয়ায় এর মধ্যে মোট সাতাত্তরটি অংশ সৃষ্টি হয়েছে।
লম্বালম্বিভাবে বিন্যস্ত মাঝের সারিতে সাতটি চৌচালা এবং অন্যান্য সারিগুলোতে আধা-বেলনাকার গম্বুজ রয়েছে। এই ছাদ-পরিকল্পনার ভার বহনের জন্য ছাদের নিচের অংশে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত ষাটটি পাথরের থামের ওপর প্রতিষ্ঠিত খিলান ও পেনডেনটিভ রয়েছে। অনেকের ধারণা,এই ষাটটি থামের অস্তিত্ব থেকেই মসজিদটি ‘ষাটখাম্বাজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।ষাটখাম্বাজ নামের একটি বিকৃত কথ্যরূপ ষাটগম্বুজ।
বেলা সাড়ে ৫টার দিকে মসজিদ পরিদর্শন শেষে ভ্যানগাড়িতে চড়ে অনতিদূরে ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে খান জাহান আলী মাজার ও লাগোয়া বড় দিঘি পরিদর্শনে এলাম।যারা মাজারভক্ত তারা আসে এখানে নানা মানতে।
যতবার এখানে এসেছি ততবার চট্টগ্রামের লোকজনের দেখা পেয়েছি।এবারও পেলাম।ছেলেটিকে খান জাহান আলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিলাম।
এখানকার বিশাল দিঘিটি আমার খুব প্রিয় দর্শনীয় স্থান।দিঘির চারদিকে প্রচুর গাছগাছালি। সবুজের সমারোহ।চোখ জুড়ায় মন ভরে।এর শানবাঁধানো ঘাটে বসে দখিনা হাওয়ার আমি শান্তির পরশ খুঁজে পাই বারবার। ছেলেটিরও দিঘির হাওয়ায় মনে হলো মন ভরে গেল।স্থানীয় এক শ্রেণির মানুষ, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নিয়তে মানতে দিঘির জল পান করে।এদিন চোখের সামনে বেশ কয়েক
জনকে দেখলাম মাথায় জল ঢালতে ও পান করতে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে।শান্তির ছোঁয়ার বসে দিঘির হাওয়ায় মিশে যাই আমরা।সাতটার দিকে অনিচ্ছা সত্বেও প্রস্থান।রওয়ানা দিলাম বাগেরহাট গণপূর্তের রেস্টহাউজের উদ্দেশ্যে। এখানে এসে খুব ভালো লাগলো। চমৎকার কক্ষ।রাতের আহার সেরে এসি চালিয়ে অঘোর ঘুমে ডুবে গেলাম।অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ১৫শ বিসিএস ব্যাচমেট প্রকৌশলী বন্ধু খায়েরকে।
আজানের সুর ধ্বনিতে জেগে ওঠলাম।অটোরিকশায় বাগেরহাট বাস ষ্টেশনে পৌঁছে সকাল ৫ঃ৪০ এর দৌলা পরিবহন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছুটে চলে।
আবারও পদ্মা সেতু পারাপারে দারুণ শিহরিত হলাম পিতাপুত্র।সকাল ৯ঃ০০টার দিকে গুলিস্তানে এসে পৌঁছলাম।পাশে রাজধানী রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা সেরে বুয়েট ক্যাম্পাসে চলে এলাম। এখানে যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. নাসিম হাসান আজাদ ও একই বিভাগের শিক্ষক ড.আমান উদ্দিন সুমনের আন্তরিক আতিথেয়তা কখনও ভুলার নয়।
উল্লেখ্য,এই দুই কীর্তিমান শিক্ষক আমাদের একই এলাকার।