বাংলাদেশে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী তথা যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে তাদের ‘পিটিয়ে মেরে’ ফেলা হয়েছে। এসব মৃত্যুতে কোন ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগও উঠেছে।
গোপালগঞ্জে সেনাসদস্যের ওপর হামলা, গাড়িতে আগুন ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার মামলায় কারাগারে থাকা এক আসামি গত ৭ই সেপ্টেম্বর হাসপাতালে মারা গেছেন।
এরপর গাইবান্ধায় যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় নির্যাতনে দুই ব্যক্তি মারা গেছে বলে অভিযোগ ওঠে।
গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের অভিযোগ ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মানুষের নির্যাতন ও মৃত্যু।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের এক দফা দাবির সময় অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে সারা দেশে কয়েকশ থানায় হামলা এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানের ঘোষণা দেয়া হয়।
কিন্তু গত এক সপ্তাহে এই অভিযানের সময় গ্রেপ্তারকৃত তিন জনের মৃত্যুতে আবারও শেখ হাসিনার সরকারের সময়কার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকাবস্থায় মৃত্যুর উদাহরণেরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, অন্য যে কোন সরকারের চেয়ে এই সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশের নাগরিকরা যে আস্থাহীনতায় ভুগছেন সেই জায়গা থেকে উত্তরণে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
ফলে সংস্কারের অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অতীতের অভ্যাস’ থেকে বেরিয়ে কিভাবে আস্থা ফেরানো যায় সে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান মানবাধিকার কর্মীরা।
মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, অন্য সব সরকারের চাইতে এই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশের নাগরিকরা এখনো যে আস্থাহীনতায় ভুগছে তা নিরসন করে আস্থার জায়গা পুনরুদ্ধার করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের আগে পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর মানসিকতা পরিবর্তনে উদ্যোগ নিতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তো পরিবর্তন ঘটেনি। আগের ব্যক্তিদের আগের সেই মানসিকতাই রয়েছে। মানুষ তো ভরসা পাচ্ছে না”।
“পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভ্যাস পরিবর্তনের কোন প্রক্রিয়া এখনো হয়নি। এদের অভ্যাসের পরিবর্তন জরুরি বলে আমি মনে করি। ফলে বাংলাদেশের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা বর্তমান সরকারের জন্য একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি। কারণ আস্থাহীনতায় বাংলাদেশের নাগরিকরা এখনো ভুগছে বলে আমি মনে করি” বলেন মি. ফয়সাল।
রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে গোড়া থেকেই সংস্কার করতে হবে বলে মনে করেন মি. ফয়সাল।
মি. ফয়সাল বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা রোধ করা যাবে না”।
“আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের শৃঙ্খলা কিভাবে রাখতে হয়, কিভাবে মানবাধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হয় সেটাতো শেখাতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশী সাহায্যও নিতে পারে বাংলাদেশ সরকার”।
মৃত ব্যক্তির নামেই মামলা ?
গাইবান্ধার সাঘাটায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনীর অভিযানে সোমবার রাতে একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে দুইজন মঙ্গলবার মারা গেছেন।
তাদের ‘পিটিয়ে মেরে ফেলার’ অভিযোগ তুলেছেন পরিবারের সদস্য ও অন্য আটককৃতরা। তবে, এ অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ বলছে, যারা মারা গেছেন তাদের ‘শারীরিক অসুস্থতা’ ছিল।
হাসপাতালে ভর্তির সময় তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে, সেগুলোই মৃত্যুর কারণ কি না তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
নিহত সোহরাব হোসেন আপেলের স্ত্রীর দাবি, পরিবারের সবাইকে একটা রুমে আটকে রেখে আপেলকে মারধর করা হয়।
“আমার স্বামীর কাছে কোন অস্ত্র ছিল না। সে দাপাচ্ছিল,” বলেন সোহরাব হোসেনের স্ত্রী।
“প্রশাসন যে একটা লোককে মারতে মারতে মাইরে ফেলায় দিবে, এটা আমাদের জানা ছিল না” বলছিলেন মি. আপেলের স্ত্রীর চাচাতো ভাই মো. বিপ্লব।
আরেক গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মোশাররফ হোসেন সুইটের অভিযোগ, ভোর পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা।
কিন্তু গ্রেপ্তারের পর যারা মারা গেছেন তাদেরসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা করেছে পুলিশ।
গাইবান্ধার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডমিন এন্ড ফিন্যান্স) ইবনে মিজান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অভিযানে গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের কারণে মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী।
মামলায় আসামিরা হলেন, সাঘাটা ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি ও ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন সুইট, শাহাদাৎ হোসেন পলাশ, রিয়াজুল ইসলাম রকি, সোহরাব হোসেন আপেল এবং শফিকুল ইসলাম।
আসামিদের মধ্যে সোহরাব হোসেন আপেল ও শফিকুল ইসলামকে যৌথ বাহিনী গ্রেফতারের পর তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মঙ্গলবার (১০ই সেপ্টেম্বর) বেলা ১২ টার দিকে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে আপেলের মৃত্যু হয় এবং একইদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শফিকুল ইসলাম শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
এদিকে, গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে আপেলের মৃত্যুর পর চিকিৎসাধীন দুইজনের একজন শাহাদাৎ হোসেনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
অপরজন চেয়ারম্যান মোশাররফ সুইট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এছাড়া রিয়াজুল ইসলাম রকি বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
অপরদিকে, গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে মারা যাওয়া সোহরাব হোসেন আপেল ও বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হওয়া শফিকুল ইসলামের ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পর নির্যাতনের কারণে সোহরাব হোসেন আপেল ও শফিকুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে স্বজন ও এলাকাবাসী।
সকাল ১০টার দিকে সাঘাটা উপজেলার ভরতখালি বাজার এলাকার সড়কে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানব-বন্ধনের নিহত ও আহতদের স্বজন ছাড়াও বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেয়।
মানব-বন্ধনে নিহতদের পরিবারের স্বজনরা দাবি করেন, গ্রেফতারের পর চেয়ারম্যান সুইটসহ ৫ জনকে বেদম মারধর ও নির্যাতন করে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। তাদের নির্যাতনের কারণেই আপেল ও শফিকুলের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করে জড়িতদের বিচার করার দাবি জানান তারা।
পুলিশ যা বলছে
গ্রেপ্তারকৃতদের নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন।
বিবিসি বাংলাকে মি. হোসেন বলেন, “ হেফাজতে না। যৌথবাহিনী সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করছে। তাদেরকে হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যু হয়েছে।”
পিটিয়ে মারার অভিযোগ অস্বীকার করে মি. হোসেন বলেন, “ এটা আসলে সত্য না। হাসপাতালে নিছেতো, এটা ডাক্তাররা সঠিক বলতে পারবে মৃত্যুর কারণ কী?”
কেন তাহলে হাসপাতালে নিতে হলো এমন প্রশ্নে মি. হোসেনের দাবি অভিযানের সময় ওই দুই ব্যক্তি অসুস্থ বোধ করায় তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
“অপারেশনের সময় তারা অসুস্থ ফীল করছেতো” বলেন মি. হোসেন।
তবে, এখনো দুই ব্যক্তির মৃত্যর ঘটনায় কোন মামলা হয় নি বলে জানান পুলিশ সুপার মি. হোসেন।
মৃত ব্যক্তির নামে মামলা প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইবনে মিজান বলেন, “মামলার চার্জশিটে তাদের নাম বাদ পড়বে”।
তবে, মৃত ব্যক্তির নামে মামলা প্রসঙ্গে এই মামলার বাদী ও সাঘাটা থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) দীপক কুমার রায়ের দাবি, ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যুর আগেই মঙ্গলবার সকালে পাঁচজনের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।
হেফাজতে মৃত্যু কত?
নিষ্ঠুর এবং লাঞ্চনাকর আচরণ বা শাস্তি থেকে মুক্ত থাকার বিষয়ে সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রায়ই নাগরিকদের এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার বা আটক করার পর হেফাজতকালীন সময়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়ের ক্ষেত্রে এই ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।
২০১৩ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা ৭২ জন বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। এমন প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঘটনা রোধে ও বিচারের জন্য আইন করতে তৎকালীন সরকারের ওপর মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপ বাড়তে থাকে।
ওই বছরই ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু(নিবারণ) আইন- ২০১৩’ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
যদিও এরপরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর এ ধরনের আরো ঘটনা ঘটার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় মাত্র একটি মামলার বিচার হয়েছে।
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে বলা হয়েছে “কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে যদি নির্যাতন করেন এবং উক্ত নির্যাতনের ফলে উক্ত ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহা হইলে নির্যাতনকারী এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তজ্জন্য তিনি অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন”।
এ বছরের গত ১৩ই জুন হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট।
গত ২০ বছরে দেশে কারা ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা জানাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ওই আদেশ দেয়।
ছয় মাসের মধ্যে ওই প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবকে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি