‘পর্যটন খাত’ এখন একটি অর্থনৈতিক শিল্প হিসেবে সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত সত্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটন শিল্পের আয় হতে বার্ষিক বাজেটের সিংহভাগ অর্থ যোগান দিচ্ছে। অনেক দেশের অর্থনীতির একটি মুখ্য উপাদান এই শিল্প । কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াও বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পর্যটন শিল্প অনেক দেশেরই শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হয়েছে। পর্যটনে বিদেশি পর্যটক নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণে এসে থাকা-খাওয়া, যাতায়াত, বিনোদন ইত্যাদিতে যে অর্থ ব্যয় করে তা অন্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে অর্জিত হয়।
নেপাল, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জাতীয় আয়ের একটা বড় অংশ অর্জিত হয় এ খাত থেকে। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রধান অংশ পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল।
ইউএনডব্লিউটিওর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ছিলো মাত্র আড়াই কোটি। ২০১২ সালে বেড়ে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১শ ৩৫ কোটি। অঞ্চলভিত্তিতে ২০১২ সালে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের আগমন ঘটেছে ইউরোপ, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। ২০১২ সালে বিশ্ব পর্যটন আয় জিডিপির ৯ শতাংশ, যা বিশ্ব রপ্তানির ৬ শতাংশ। এর রপ্তানিমূল্য ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ খাতে প্রতি ১০ জনে একজনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
২০১৯ সালে মালেশিয়ার পর্যটন খাতে আয় ছিল ৬৬ দশমিক ১ বিলিয়ন রিঙ্গিত। পর্যটন খাতের নেপালের আয় জুন পর্যন্ত ১১ মাসে দেশটিতে আয় হয়েছে ২০ কোটি ডলারের বেশি। পর্যটন খাত হতে মালদ্বীপের আয় ২ বিলিয়ন রুপিয়া। যা জিডিপির ২৮% এবং বৈদেশিক বিনিময় প্রাপ্তির ৬০% এরও বেশি। মালে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, পর্যটকের সেবার মানে কোনো আপোস নেই মালদ্বীপে। পর্যটকরা যেনো অসন্তুষ্ট না হোন, সেজন্য সরকারি পরিদর্শকেরা সবকিছু তদারক করেন।
আমাদের দেশে ২০১৯ সালে দেশের জাতীয় আয়ে পর্যটন খাতের অবদান ছিল ৯৫০ দশমিক ৭ বিলিয়ন টাকা যা জিডিপির ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে তা ৬ শতাংশে পরিণত হবে বলে আশাকরা যায়। এখানে পর্যটন খাতে মোট কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের। তবে এই আয় প্রত্যাশা অনুযায়ী নয় বলেই অনেকে মনে করেন।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো অসংখ্য নৈসর্গিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ধর্মীয় নিদর্শন ও স্থান রয়েছে । পৃথিবীর ‘দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার’ বাংলাদেশের প্রতি বিধাতার মহামূল্যবান উপহার ।
‘হিমছড়ি ঝরনা’, ‘ইনানী সমুদ্রসৈকত’ অপুর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত সৈকত। একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায় ‘সমুদ্রকন্যা পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে’। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বিশ্বের অন্যতম প্রবাল দ্বীপ।
রয়েলবেংগল টাইগারের বিচরণ ভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন,
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিচ, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, মহেশখালী, টেকনাফ, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কাপ্তাই- রাংগামাটি লেকের বিস্তীর্ণ জলরাশি যে কারও মন কেড়ে নেবে। রামগড়-খাগড়াছড়ি-বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকা, চা বাগান , চট্টগ্রামের পাহাড়ের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ‘ফয়েজলেক’, বাঁশখালী চা-বাগান, বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতের বাহারছড়া পয়েন্ট, বাঁশখালী ইকোপার্ক, মায়া হরিণের জাদুমাখা ‘সোনাদিয়া চর’, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের জাফলং এলাকা-চা বাগান অপার সৌন্দর্যের আধার।
ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, রামসাগর, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, ষাট গম্বুজ মসজিদ, আহসান মঞ্জিল ও কুষ্টিয়ার লালন শাহের আখড়া, চট্টগ্রামের পরীর পাহাড় খ্যাত কোর্ট বিল্ডিং, দেয়াং পাহাড়। রয়েছে ঐতিহাসিক স্থান, যেমন-জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় শহীদ মিনার, জাতীয় কবির কবরস্থান, বাহাদুর শাহ পার্ক, কার্জন হল ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রভৃতি।
রামুতে রয়েছে কয়েক ডজন দর্শনীয় স্থান। দেশের সর্ববৃহৎ রাবার বাগান, আস্ত জাহাজের আদলে গড়ন স্বপ্নতরী ও সাড়ে ৩০০ বছরের পুরোনো কানা রাজার সুরঙ্গ এ উপজেলার অন্যতম আকর্ষণ। রয়েছে থাই টেম্পলের আদলে গড়ে ওঠা বৌদ্ধ মন্দিরগুলো। মন্দিরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সম্রাট অশোক নির্মিত ঐতিহাসিক রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার, উত্তর মিঠাছড়ির একশো ফুট সিংহ শয্যা গৌতম বুদ্ধ মূর্তি, চেরাংঘাটা সড়কে অবস্থিত সাদা চিং ও লাল চিং বৌদ্ধ বিহার, উখিয়ার ঘোনা পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত প্রাচীন বৌদ্ধ জাদি, লামার পাড়া বৌদ্ধ বিহারও হাজারীকুল বোধিরত্ন বৌদ্ধ বিহার, গৌতম বুদ্ধের সিংহ শয্যা একশ ফুট মূর্তি । এসব মন্দির পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে অনায়াসে।
আমরা দূ:খের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে কমবেশি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দেশের প্রায় সব খাত। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে অর্থনীতিতে। কিন্তু পর্যটন খাত রয়েছে ব্যতিক্রম উদাহরণ হিসেবে । নানা ‘অব্যবস্থাপনা আর সমন্বয়হীনতায়’ কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না পর্যটন। ফলে বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশ ভ্রমণে আকৃষ্ট হচ্ছে না।
অভিযোগ আছে, গত তিন বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কতসংখ্যক পর্যটক বাংলাদেশে এসেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নাই বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের কাছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পর্যটন করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে বিদেশি পর্যটকদের হালনাগাদ তথ্য থাকে। সেখান থেকে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা জানা যায়। কিন্তু পর্যটন করপোরেশনের তা জানা বা তথ্য সংগ্রহে কোনো আগ্রহ নেই।
অন্যএক কর্মকর্তা বলেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে তথ্য জানতে ইমিগ্রেশনে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। অবশ্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে পর্যটক এসেছিলেন তিন লাখ ২৩ হাজার। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে এখন পর্যন্ত আর কোনো পর্যটক আসেননি। বিদেশি নাগরিক বা পর্যটকদের জন্য নানান বিধিনিষেধ ছিল। পরে গত ২৬ সেপ্টেম্বর’২১ থেকে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আসার বিধিনিষেধ তুলে দেয় সরকার। এ ছাড়া বিদেশিদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। (পর্যটকদের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা প্রয়োজন)।
এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অবস্থা খুবই নাজুক। উল্লেখ্য, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে একেবারেই পেছনের সারিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১১০তম। ২০১৯ সালে ছিল ১১৩তম। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘সংকট উত্তরণে কার্যকর পথনকশা না থাকা, প্রচার-প্রচারণার অভাব, দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় ও করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং অদক্ষতার কারণে’ দেশের পর্যটন খাতের এই দশা হয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, ‘পরিকল্পনার ঘাটতি এবং পরিবেশ তৈরি করতে না পারায় দেশের পর্যটন খাত পিছিয়ে রয়েছে’।
এ ছাড়া দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো নিয়ে বিদেশে কোনো প্রচার-প্রচারণা চালানো হয় না। তাছাড়া ‘অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা’ পর্যটনের অন্যতম বাঁধা হিসেবে চিহ্নিত। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মাত্র ১৪৮ কিমি রাস্তা, অথচ সড়ক পথে যেতে লাগে ৪/৫ ঘন্টা। বাংলাদেশের সড়কের ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা/ট্রাফিক জ্যাম- পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অন্যতম বাঁধা। কক্সবাজারে পর্যটকদের “নিরাপত্তাহীনতা”ও পর্যটকদের ভীতির কারণ।
সেফটি ফার্স্ট -এই শ্লোগানের বাস্তবায়ন জরুরি। কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ‘ ২৪ ঘন্টা অবাধ বিচারণের নিরাপত্তা ও এলকোহলের’ নিশ্চয়তা দেয়া হলে তাঁদের আকৃষ্ট করা যাবে (পৃথিবীর সব দেশেই এই চিত্র দেখা যায়)। রোহিংগাদের অবাধ বিচারণও পর্যটকদের কাছে হুমকি মনে হতে পারে । স্মরণকরা যেতে পারে যে, কক্সবাজারে বেসরকারি হোটেল যেভাবে প্রসার লাভ করেছে, সেভাবে পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল-মোটেল নির্মাণ করা হয়নি। পর্যটন খাতে নানা সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বিদায়ী চেয়ারম্যান আলী কদর বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে এ খাতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছি না। এখন পর্যটন খাতের উন্নয়নে ৩০ বছর মেয়াদি একটা মহাপরিকল্পনার প্রণয়নের কাজ চলছে।’
গত ২৭ সেপ্টেম্বর’২২ বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে বর্ণাঢ্য ঢাকার আগারগাঁওয়ে শোভাযাত্রা, সভা-সেমিনারসহ নানান কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করেছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। কিন্তু বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে তেমন কোনো কর্মসূচি ছিল না। করপোরেশনের এমন কর্মকাণ্ডে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে ৩ দিন ব্যাপি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম এক্সপো (বিআইটিটিআই)। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) আয়োজিত মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
‘পর্যটন খাতে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বিদেশি পর্যটক আসছে না’ বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বিদেশি পর্যটকদের যেসব চাহিদা- তা আমরা পূরণ করতে পারি না। এখন তাদের আকর্ষণে নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী আগামীতে কাজ করা হবে। কিন্তু কী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, কবেই বা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে তার কিছুই তিনি বলেননি।
বর্তমানে পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান পদে আছেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ইংরেজি সাহিত্য পড়াশোনা করা রাহাত আনোয়ার। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনে যোগদানের আগে তিনি বাংলাদেশ জুটস মিলস করপোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। এর আগে তিনি সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ।
এছাড়াও তিনি জেলা প্রশাসকও ছিলেন।অথচ এই পদে ‘বিশ্ব পর্যটন শিল্প’ সম্পর্কে অভিজ্ঞ কাউকে নিয়োগ দিলে এই শিল্পের উন্নতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতেন বলে অনেকে মনে করেন। শুধুমাত্র চেয়ারম্যান নয়, পর্যটন শিল্প নিয়ে উন্নত ডিগ্রীধারীদের নিয়োগ দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত বলে আমরা মনেকরি। (বিদেশে পড়াশোনা করা বাংলাদেশি) ইতোমধ্যে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন চালু হয়েছে। চালু হবে আধুনিক বিমানবন্দর। আগামীতে কক্সবাজারে পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম হবে বলে আমরা আশাবাদী। তাই কক্সবাজার-টেকনাফ, সেন্ট মার্টিনসহ উক্ত এলাকাকে আধুনিক পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আশাকরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।