সমুদ্র ও দেশের ৭১৫ কিলোমিটার লম্বা উপকূলের ছোট-বড় ৭৫টি দ্বীপকে কাজে লাগিয়ে সুনীল পর্যটন উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব। এজন্য দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনার।
মঙ্গলবার (৬ডিসেম্বর) সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজারে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সম্মেলন কক্ষে এ কর্মশালায় বক্তারা এ তথ্য উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: মোকাম্মেল হোসেন। এতে মুলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনা করেন, ইউএনডিপি’র এক্সেলারেটর ল্যাব বাংলাদেশের হেড অব এক্সপেরিমেশন রমিজ উদ্দিন। কর্মশালায় আলোচক ছিলেন, ককক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ নুরুল আবছার, ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার মো: মিজানুর রহমান, কর্ণফুলী সীপ বিল্ডার্সের কনসালটেন্ট ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল হালিম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এম, এ রশীদ সহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীরা।
কর্মশালায় বক্তারা বলেন, ‘বাংলাদেশের ৭১৫ কিলোমিটার লম্বা উপকূল রেখাসহ উপকূল ও সমুদ্রে ছোট-বড় সব মিলিয়ে রয়েছে ৭৫টি দ্বীপ। গভীর সমুদ্রের জলজ প্রাণবৈচিত্র্য, প্রবাল বসতি, বালুময় সমুদ্রসৈকত, বালিয়াড়ি, নানা ধরনের দ্বীপ এবং সমুদ্র ভ্রমণ পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমাদের দীর্ঘ উপকূল, বিশালাকৃতির নদীসমূহ এবং নদীর মোহনা, দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, নানা প্রজাতির মাছ ও পাখি, সমুদ্র তীরবর্তী ও দূরবর্তী অনেক দ্বীপ, উপকূলীয় মানুষের জীবনধারা, হাজার বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী রকেট স্টীমার সার্ভিস, নানা ধরণের সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র ভ্রমণ ও পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দেশ।
বঙ্গোপসাগরে এক লক্ষ আঠারো হাজার আটশত তেরো বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত উপকূলীয় সমুদ্রসীমা ও বিস্তৃত জলরাশি আমাদের সমুদ্র ও উপকূলীয় পর্যটনের সম্ভাবনাকে আরো বিস্তৃত করেছে। অধিকাংশ পর্যটকের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে প্রমোদতরীতে সমুদ্রভ্রমণ এবং সমুদ্র ও উপকূলভিত্তিক পর্যটন ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম।
ইউএনডব্লিউটিও’র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ এ বিশ্ব জিডিপি-তে সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের অবদান ৫% এবং বিশ্ব কর্মসংস্থানে অবদান ৬%-৭%। এটি উপকূলীয় লোকজনের জীবনমান উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অধিবাসীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, পণ্য ও সেবা সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি, স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রচার, পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ, জনগণের জীবিকার বিকল্প উপায় এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বক্তারা আরো বলেন, সুনীল পর্যটন হল একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা এবং উদ্ভাবন প্রকল্প যা সমুদ্রের আশেপাশে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পর্যটনের পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, শাসন এবং পরিকল্পনার উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে। মুলত সুনীল পর্যটনের দুইটি অংশ সমুদ্রভিত্তিক পর্যটন এবং উপকূলভিত্তিক পর্যটন। সমুদ্রভিত্তিক পর্যটন বলতে সমুদ্র কেন্দ্রীক আনন্দ ভ্রমনের কার্যক্রমকেই বুঝায়। সমুদ্রভিত্তিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে প্রমোদতরীতে সমুদ্রভ্রমণ, সমুদ্রে মৎস্য শিকার, নৌকা পরিসেবা, নৌকাচালনা, ওয়াটার স্কিইং, জেট স্কিইং, সাং সেইল বোর্ডিং, সি কায়াকিং, স্কুবা ডাইভিং, সমুদ্রে সাঁতার, তিমি, ডলফিন দেখা, দ্বীপ ভ্রমণ, ভাসমান রেস্টুরেন্ট, জলক্রীড়া ইত্যাদি।
অন্যদিকে, উপকূলভিত্তিক পর্যটন হল যেখানে পর্যটকরা উপকূলীয় পরিবেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উপভোগ করে। উপকূলভিত্তিক পর্যটনের মধ্যে রয়েছে, সাতার, সার্ফিং, সূর্যমান, বীচ কার্ণিভাল, বাঁচ খেলা, লাইভ কনসার্ট, মেরিন একুরিয়াম ও মেরিন মিউজিয়াম উপভোগ এবং অন্যান্য সমুদ্র সৈকতভিত্তিক পর্যটন ক্রিয়াকলাপ।
কর্মশালায় এক রিপোর্টে বলা হয়, সুনীল পর্যটন উন্নয়ন ও বিকাশে যে সকল বাঁধাসমূহ সনাক্ত করা হয়েছে তা হল, সুনীল পর্যটন উন্নয়ন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে একটি উপায়, তা উপলব্ধির অভাব: সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়,বিভাগ, দপ্তর, সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব বেসরকারী উদ্যোগকে উৎসাহিত না করে বাধা সৃষ্টি করা: অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকা এবং অনুমোদন পাওয়ার জন্য নানা দত্তর সংস্থায় যাতায়াত করা।
অন্যদিকে, সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য সেবা সহজীকরণের বিষয়ে ট্যুরিজম বোর্ডের যেসব প্রস্তাবনা প্রদান করা হয়েছে তা হল: আন্তর্জাতিক সমুদ্রভ্রমণ প্রমোদতরীর জন্য অনলাইনে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা; কোন কর্তৃপক্ষ আবেদন খারিজ করলে সে বিষয়ে আপীল করার জন্য কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করা; সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থাসমূহের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করা। এক্ষেত্রে সুনীল পর্যটন উন্নয়নের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
কর্মশালায় বলা হয়, সুনীল পর্যটন উন্নয়নে সরকারী সংস্থার করনীয় সমূহ হল সমুদ্রবন্দরসমূহ আধুনিকায়ন, সমুদ্রবন্দরকর্মীদের পর্যটন বান্ধব করা, স্টেকহোল্ডারদের প্রশিক্ষণ, ভিসানীতি সহজ করা, ভিসা নীতিমালায় সমুদ্রবন্দর অন্তর্ভুক্ত করা, অন-অ্যারাইভাল ভিসা, অনবোর্ড ইমিগ্রেশন, পর্যটকবাহী জাহাজে অনবোর্ড কাস্টমস সুবিধা, সমুদ্রভ্রমণ প্রমোদতরী আগমনের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে বেসরকারি ট্যুর অপারেটরদের উৎসাহিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে দ্রুত ও সহজে অনুমতি প্রাপ্তি, পর্যটকবাহী জাহাজের সহজ নোঙরের ব্যবস্থা করা, যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের প্রমোদতরীর জেটিসহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্দর সুবিধা প্রদান, জাহাজের বর্জ্য নিরাপদে অপসারণের ব্যবস্থা করা। সমন্বিত উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করা।
সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন বিকাশের জন্য অভ্যন্তরীণ এবং আন্ত-আঞ্চলিক সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন খাতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা; সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন বিকাশের জনা আধুনিক ক্রুজশিপ ক্রয়, প্যাকেজ ট্যুর চালু এবং বন্দর উন্নয়নে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা; সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণীয় ডেসটিনেশন হিসেবে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং ও প্রমোট করার জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করা, সমুদ্র তীর ও উপকূলীয় অঞ্চল টেকসই করণে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় কর্তৃক যৌথভাবে কাজ করা; বিভিন্ন দ্বীপের মধ্যে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের (আইল্যান্ড হপিং) ব্যবস্থা করা; সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর/মন্ত্রণালয়/বিভাগের সাথে সমন্বয় করে ওয়ানস্টপ সার্ভিস প্রবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
অন্যদিকে সুনীল পর্যটন উন্নয়নে ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড ও পর্যটকের সংস্থার করনীয় সমূহ হল জলজপ্রাণী দেখার জন্য সুরক্ষিত এলাকায় অনুপ্রবেশ পরিহার, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের প্রজনন স্থান থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, নৌকায় সহনীয় মাত্রার শব্দবিশিষ্ট প্রোপেলার ব্যবহার, কচ্ছপ তিমি হাঙ্গর ডলফিন এবং বিপন্ন প্রজাতির মাছের মতো সামুদ্রিক প্রাণীদের স্পর্শ করা থেকে বিরত রাখা। এ বিষয়ে সচেতন ও সংবেদনশীল করার জন্য পর্যটন পরিবহন কর্মী, ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইডকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
সুনীল পর্যটন বাস্তবায়নে বিনিয়োগে আকর্ষনের জন্য করনীয় সমূহ হল সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের ক্রুজশিপ ক্রয়, সমুদ্র সৈকতের নিকটবর্তী সামুদ্রিক মৎস ও প্রাণীর একোরিয়াম স্থাপন, দ্বীপ অথবা সমুদ্র সৈকতের নিকটবর্তী হোটেলগুলোকে ইকো-রিসোর্ট এ রূপান্তর, সুন্দরবন ভ্রমণে ব্যবহৃত ক্রুজশিপ আধুনিকায়ন, দ্বীপ অথবা সমুদ্র সৈকতের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলোতে কমিউনিটি ট্যুরিজম ও হোম-স্টে চালুকরণ, সমুদ্রসৈকত কেন্দ্রিক বিভিন্ন বিনোদন এবং ক্রীড়া আয়োজন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তাগণকে সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান। সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন এবং ব্লু-ইকোনমি সংক্রান্ত দেশিয় ও আন্তর্জাতিক মেলা, সেমিনার, কর্মশালা আয়োজনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান ও সহায়তা করণ; সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন বিষয়ে সরকারিভাবে গবেষণা পরিচালনা এবং অন্যান্যদের গবেষণা পরিচালনায় প্রণোদনা প্রদান; সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন সংক্রান্ত উচ্চাশিক্ষা অর্জনে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা; সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন সংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ করতে সহায়তা প্রদান করা।