শহীদ দৌলত খাঁন। চকরিয়ার রাজপথের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সাক্ষী।স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে কক্সবাজার জেলার একমাত্র শহীদের নাম।১৯৮৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের নয় বছরের শাসনের অবসান ঘটে।পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সে সময়কার গণআন্দোলনে ৩৭০ জন্য ছাত্রজনতা জীবন দিয়েছিল,পঙ্গুত্ব বরণ করে অসংখ্যজন।১ বছর ৩২৬ দিন হরতাল, অবরোধ হয়েছিল ৭০ দিন।বিশ্ববেহায়া এরশাদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সকল ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দল প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে।রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল “১৯৮২ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সেই পরিস্থিতিকে অত্যান্ত ভয়ঙ্কর এবং বিপদজনক হিসেবে উল্লেখ করেছেন”।কার্ফু, সন্ধ্যা আইন লেগেই থাকতো। দুইজনের অধিক চলাফেরা ছিল নিষিদ্ধ, আইন অমান্যকারীদের দেখা মাত্র গুলির কিংবা ৭ বছরের জেল জরিমানার নির্দেশনা ছিল প্রশাসনের কাছে।দেশের অন্যান্য জায়গার মত চকরিয়ায়ও তীব্র আন্দোলনে রাস্তায় নামে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রজনতা।পুলিশদের ফাঁকি দিয়ে কারফিউ অমান্য করে সভা সমাবেশ ও রাতে ঝুঁকি নিয়ে মশাল মিশিল করেছি।তেমনিভাবে ৫ ডিসেম্বরে শহীদ ছাত্রনেতা দৌলত খান যে মিশিলে গুলিবিদ্ধ হয়, সেই মিছিলের সহযাত্রী ছিলাম অনেকের সাথে।তখন আমি তত্কালীন জাতীয় ছাত্রলীগ চকরিয়া কলেজ শাখার সভাপতি ।দৌলত খাঁন ছিলেন উপজেলা জাতীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় প্রতিটি সংগ্রামের পিছনে একটি লক্ষ্যমাত্রা রয়। তেমনিভাবে নব্বই দশকের সেই আন্দোলনের আকাঙ্খায় ছিল গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, বাক-স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, শিক্ষাসহ সকল মৌলিক অধিকার ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দূর্নীতি দমন করা।অন্যদিকে ছাত্র সংগঠনদের ১০ দফায় বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয় যে “১৯৮২ সাল থেকে সব রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচার করতে হবে এবং সকল শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও মর্যাদা প্রদান করতে হবে”।আন্দোলনে এরশাদশাহীর বিদায় হল। কিন্তু পরবর্তী কোন সরকারই সেসকল শর্ত মনে রাখে নাই। বেমালুম ভুলে চেপে গেছে।সামরিক শাসন বিরোধী ঐক্যবদ্ধ চেতনার সব চুক্তিবদ্ধ শর্তসমূহ নিয়ে কেউ মাথা ঘামানো প্রয়োজন মনে করে নাই। সেই গণআন্দোলনের অনেকে পরবর্তী সময়ে এমপি মন্ত্রী কিংবা বড়বড় পদে আসীন হয়েছে।নব্বই দশকের আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতার তকমায় ক্ষমতা ব্যবহার করে অঢেল টাকার মালিক হয়ে যায়।কিন্তু কেউ কথা রাখে নাই। সবাই চুক্তির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ।শুধু ভুক্তভোগীরাই মনে রেখেছে, হায় হুতাশের মাধ্যমে,যাতনার সাথে, কষ্টের মাঝে। এমনকি শহীদ পরিবারের খবর রাখার প্রয়োজন মনে করে নাই কেউ। পঙ্গু নেতাকর্মীরা চিকিৎসা সেবার নিশ্চয়তা,সহায়তা পায় নাই। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে এত ত্যাগের বিনিময়ে কি অর্জন হল? কী পেল স্বদেশ? কি লাভ হলো এত প্রাণ বলিদান?কি পেল শহীদদের পরিবার।এসকল বেদনা এখনো তাড়াকরে সে সময়কার আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের। এখনো অনেক নেতাকর্মী মানবেতর জীবন যাপন করছে।চকরিয়ার শহীদ দৌলত খাঁন ছিল তার পরিবারের বড় সন্তান, বয়স্ক মাতাপিতারএকমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে।উল্লেখ করার মতো সহযোগিতা নিয়ে কেউ তার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায় নাই।নব্বই দশকের চকরিয়ার রাজপথের প্রাণ পুরুষ জননেতা এডভোকেট আমজাদ হোসেন যখন নবগঠিত চকরিয়া পৌরসভার প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছিল তখন দৌলতের পরিবারকে দুইটি রিক্সা সহায়তা দিয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৯৬ সালে প্রথম এবং বর্তমানে তিন মেয়াদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে চলমান আছে ।অনেকে আঙুল ফুলে বটগাছ হয়েছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে চোখে পড়ার মত। কিন্তু যাদের রক্তেঘামে ভিজে দল শক্তিশালী তাদের কোন মুল্যায়ন নাই।হাইব্রিড সুবিধাবাধীদের বিপুল সংখ্যক উত্থানের ফলে অস্তিত্ব টিকে থাকার সংকট নিয়ে আছে অনেকে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গায়। জীবনবাজি করে যারা আন্দোলন করেছে তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই এরশাদকে এদেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনাই। রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আসে মানুষ। আন্দোলন দমনে এরশাদ সেনাবাহিনী ও পুলিশ লেলিয়ে একের পর এক মানুষ খুন করতে থাকে । বিক্ষোভকারীদের দমনে বেপরোয়া এরশাদ রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে।১৯৮৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর সকাল থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠে পুলিশ ।তাদের যুদ্ধাংদেহী ভূমিকা দেখে হতভম্ব হয়ে যায় চকরিয়ার আন্দোলনকারীরা। ষ্টেশনে আসা নেতাকর্মীদের বিনা উস্কানিতে তাড়া করতে থাকে, ভয় দেখিয়ে ছাত্রজনতাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে ধাওয়া দিয়ে কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।তখন রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ এবং মুক্তির দাবী নিয়ে চকরিয়া উপজেলা চত্বরে সমবেত সমাবেশে , জননেতা এডভোকেট আমজাদ হোসেনের বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। তখনই গুলিবিদ্ধ দৌলত খাঁন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।পরে হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রতিবছর ডিসেম্বর এলেই সেই ভয়াবহ মুহূর্তের দৃশ্য মানসপটে ভেসে উঠে, তাড়া করে।সেই মিশিল উপজেলায় সমবেত হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত অগ্রভাগে ছাত্রনেতা সরওয়ার আলম, মোহাম্মদ আইয়ুব (আলীকদম), খানে আলম (শীলখালী)এবং আমি এক সাথেই ছিলাম।উল্লেখ্য যে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তীব্রতা পাবার পরথেকে প্রশাসনের কড়া নজর ছিলো সরওয়ার আলমের উপর।তিনি ছিলেন তখনকার সময়ের সাহসী ছাত্রনেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন।ফলে হুলিয়া লেগেই থাকতো, গ্রেফতার আতঙ্ক তাড়া করতো সবসময়।বহুল পরিচিত ছাত্রনেতা ছিলেন তিনি । সেই দিনের পরিস্থিতি, গতিবিধি এবং পুলিশের বেপরোয়া মনোভাব বুঝতে পেরে আমার কেন জানি মনে হলো,সরওয়ার ভাইকে নাগালে পেলে পুলিশ গ্রেফতার করবেই।তাই মিছিলটি উপজেলা চত্বরের প্রবেশমুখে সরওয়ার ভাইকে ভিতরে না গিয়ে সরিয়ে থাকতে অনুরোধ করি এবং পাশের রেষ্টুরেন্ট থেকে দুইটি সিংগারা কিনে দিয়ে নাপিতের দোকানের দিকে অপেক্ষায় রাখি।সেদিনের ঘটনার পরে কেন জানি মনে হলো সরওয়ার ভাইকে সরে যাওয়ার অনুরোধ না করলে হয়তোবা ঘটনা অন্যভাবে লিখতে হতো আজকের দিনে।(আমি আমার নিজস্ব মতামত তুলে ধরলাম মাত্র)।আন্দোলন রত সবারই গৌরবময় ভূমিকা অনস্বীকার্য।সবার ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল স্বৈরশাসকের বিতাড়ন। কমবেশি ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছে,হুমকির মাঝে ছিলো সবাই ।প্রতি ডিসেম্বর মাস এলেই অন্য আরেকটি স্মৃতি এখনো ভেসে উঠে,মনে পড়ে বারবার, ৫ ডিসেম্বরের দিনটিতে হ্নদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।দৌলত খান গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথেই বাতাসের বেগে খবর হয়ে যায় যে ঢেমুশিয়ার(আমার গ্রাম) একটি ছেলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়। তখন কোণাখালী ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হয় নাই।উপকুলীয় এই এলাকায় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম বলে সবাই ধরে নিয়েছিল যে গুলিবিদ্ধ হয়ে আমিই মারা গেছি। ফলে ছেলের মৃত্যু সংবাদে আমার মায়ের কান্না বিলাপ শুরু হয়ে যায় । পাড়া প্রতিবেশি সহ আত্মীয়স্বজন সবায় শোকাভিভূত হয়ে পড়ে । তখন মোবাইলের যুগ ছিল না বিধায় তাত্ক্ষণিকভাবে জানার সুযোগ ছিল না। সেদিন হয়তোবা আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্যকেউও হতে পারতো দৌলত খানের সাথে কিংবা আমি ।কারণ সেদিন শত-শত ছাত্রজনতা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শামিল ছিল। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য মানসপটে ভেসে উটলেই হতবিহ্বল হয়ে যাই।রাজনৈতিক বিজ্ঞদের মতে,”নব্বই দশকের আন্দোলন দেশপ্রেমের ঐতিহাসিক ছবক হয়ে থাকবে। নিঃস্বার্থ ভাবে খেয়ে না খেয়ে রাজপথে আন্দোলন করেছে সবাই”। চিরিংগায় পপুলার বেকারির রুটি ছিল তখনকার রাজনৈতিক কর্মীদের উত্তম খাবার। কিন্তু আজকাল রাজনীতির সে চিরচেনা চেতনা মৃতপ্রায়।ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রদের কোন দাবি নিয়ে শোর উঠে না।দলের সাইনবোর্ডে টেন্ডারবাজী লাইসেন্সবাজী ও দখলবেদখল নিয়ে নেতাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায়। দিনের পর দিন রাজনীতির এ হাল দেখে সাধারণ মানুষের মাঝে হতাশা ও বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে।তাই বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, “রাজনীতিবিদরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে দেশের স্থিতিশীল সামষ্টিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়”।তাই রাজনীতিতে সুস্থতা ফিরিয়ে আসুক কামনা করে নিবেদিত ত্যাগী কর্মীরা।
৫ ডিসেম্বরের শহীদ দৌলত খাঁনের আত্মার শান্তি কামনা করছি।সাথে সাথে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন -২০২৪, কক্সবাজার -১ আসনের নির্বাচিত সাংসদের প্রতি নব্বই দশকের ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে শহীদ দৌলত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেবার দাবি জানাচ্ছি।তার স্মৃতি ধরে রাখতে তাঁর জন্মস্থান কোণাখালী ইউনিয়নের নাম “দৌলত নগর” নামকরণ করা সহ প্রস্তাবিত মাতামুহুরি উপজেলা কার্যক্রম শুরু হলে নবগঠিত সে উপজেলার অডিটোরিয়ামের নাম “শহীদ দৌলতের” নামে নামকরণ করতে দাবি জানাচ্ছি। কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরি সংলগ্ন শহীদ দৌলত ময়দানের নামফলক এবং চকরিয়া থানা রাস্তার মাথা থেকে উপজেলা পর্যন্ত দৌলত সড়কের নামফলক লাগানোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে।
অমর হউক শহীদ স্মৃতি, দৌলত খাঁন স্মৃতি।
জয় বাংলা।
———————–
বদরুল ইসলাম বাদল
নব্বই দশকের সাবেক ছাত্রনেতা এবং সমাজকর্মী