বাড়ির পাশের স্কুলটির নাম নিজপানখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাবা এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পাশ করে তিনি চিরিংগা আবেদা ফকির সাহেবের মাজারের (নামার চিরিঙ্গা এলাকা) পূর্ব পাশে ছোট্ট একটি ঘর তৈরি করে পাঠ্যপুস্তক ব্যবসা শুরু করেন। ২০০০ সাল পর্যন্ত পাঠ্য বই বিক্রির এই ব্যবসা তিনি করে গেছেন।
আজকের চিরিংগা বাণিজ্যিক এলাকা তখন নামার চিরিংগা এলাকায় ছিল। এখানেই থানা, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস, শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে প্রায় সব সরকারি অফিস ছিল। সরকারি কাজে এখানে লোক সমাগম হতে থাকায় এ এলাকায় একটি বাজার তৈরি হয়। তখন আরাকান সড়কও এ এলাকার বুক চিড়ে আরাকানের দিকে চলে গিয়েছিল। ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে মাতামুহুরির ভাঙ্গনে এ এলাকায় দিয়ে চলে যাওয়া আরাকান সড়কের কয়েক কিলোমিটার যেমন বিধ্বস্ত হয়, তেমনি বিভিন্ন সরকারি অফিসও নদী ভাঙ্গনের হুমকিতে পড়ে। ফলে থানা সদর এখান থেকে সরে বর্তমান অবস্থানে চলে আসে।
চকরিয়া থানা শিক্ষা কর্মকর্তার (টিইও) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৫৭ সালে বাবা শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। বিভিন্ন স্কুলে কর্ম করে ১৯৬৮ সালের দিকে বদলী হয়ে তিনি আসেন চকরিয়ার নিজপানখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
এই স্কুলেই আমার হাতেখড়ি। তিনি এই স্কুলে বদলী হয়ে আসেন মূলত আমাকে তৈরি করার জন্য। স্কুলে গতানুগতিক পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি আমাদেরকে গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও অভিনয় শিখাতেন। তিনি নিজে একজন সাংস্কৃতিক কর্মী ছিলেন। ছাত্রবেলায় নাটকেও অভিনয় করেছেন বলে জেনেছি। চকরিয়ার বদরখালী হাই স্কুলে অধ্যয়নকালীন তিনি ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় হন, পুলিশ তাঁকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। বদরখালীর জোবাইর আহমদ বিএসসি জানিয়েছেন, ‘তারা একদল শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সুদূর বদরখালী থেকে পায়ে হেটে চকরিয়া থানায় উপস্থিত হয়ে আমার বাবা ও আটক হওয়া আরেকজন শিক্ষার্থীকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যান।
একজন শিক্ষক হিসেবে লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি এক্সট্রা কারিকুলার কর্যক্রমে গুরুত্ব দিতেন। স্কুলে বিভিন্ন সময় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করে উৎসাহ ও প্রেরণা দিতেন।
স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথের উপর বড়ুয়া পাড়া। প্রায় দিন কোনো না কোনো বড়ুয়ার বাড়িতে আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন। এই পাড়ার প্রত্যেকের সাথে ছিল বাবার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। নানা সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য ওরা বাবার কাছে আসতেন।
আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে এক কিলোমিটার দূরত্বে সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং একই দূরত্বে বাড়ির পশ্চিম পাশে রাখাইনদের পল্লী। এইসব সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে বাবার নিবিড় সম্পর্ক আমাদের অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রেরণা।
আজীবন শিক্ষকতায় উৎসর্গীকৃত আমার বাবা আমাকে তৈরি করছেন। তাই বাবার চোখে জগৎ দেখতে দেখতে আমার বেড়ে উঠা। আমার যা কিছু অর্জন বাবার কারণেই।
বাবা নেই আজ তিন বছর। বৈশ্বিক মহামারী করোনা আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের আজকের এইদিনে চট্টগ্রাম ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মহান আল্লাহ আপনি আমার শিক্ষক বাবাকে ক্ষমা করুন, তাঁকে বেহেশত নসিব করুন। স্বভাবতই আজ আমি অনেক বিষণ্ণ।
বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর এই দিনে একমাত্র ছোট ভাইটি (এ কে এম জামীরউদ্দিন রাসেল) আমার পাশে থাকতো। কিন্তু সেও এখন অনেক দূরে। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরী স্টেট ইউনিভার্সিটিতে টিচিং এসিস্ট্যান্ট হিসেবে সে কাজ করে, পড়ে এবং পড়ায়। ডেইলি স্টার পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টারের কাজে আপাতত ইস্তফা দিয়ে সে পৈত্রিক পেশা শিক্ষকতায় ফেরার জন্য নিজেকে তৈরি করছে। আমি তাকেও খুব মিস করি।