সে যাহা করে তাহার সবটা হয়ত আমার পছন্দ নহে,
আমার যাহা পছন্দ তাহার সবটা হয়ত করে না সে-
যখন তাহার মুখে হাসি দেখি ভালবাসি
যখন সে বিষণ্ণ আমি মুণ্ডপাত করি আপনার (পৃ.৯০)
কবির মুখে এমন উচ্চারণ ও ভালবাসা পাঠকের হৃদয়ে স্থান পায়। যা পাঠকের মন জয় করে বহুদূর এগিয়ে যাবে। ফিনল্যান্ডের সুপরিচিত ও আলোচিত কবি হলেন পেন্টি সারিকস্কি। ফিনল্যান্ড ইতিহাসে সুমিদেশ হিসেবে পরিচিত। আর পেন্টি সারিকস্কি হচ্ছেন ফিনিশ ভাষার একজন খ্যাতিমান ও আলোচিত কবি। অনুবাদক আনসেলম হলো সুমিভাষী একজন স্বনামধন্য কবি। কবিতা চিন্তার – ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। ‘পেন্টি সারিকস্কির কবিতার মতন নতুন কবিতা যে ভাষায় লেখা হয় জগৎসভায় সে ভাষার মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। যাঁহাদের বলার অধিকার তাঁহারা বলিতেছেন, এই কবির শক্তি সুমির মর্যাদা বৃদ্ধি করিয়াছে, তাঁহার শক্তি দুনিয়ার যেকোন নমস্য কবির তুলনীয়। ‘ (পৃ.১৫)
পেন্টি সারিকস্কি: উহারা বাতাসে একটি কবিতার বই। বইটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেন বরেণ্য লেখক সলিমুল্লাহ খান। পেন্টি সারিকস্কি বইটি সুমি ভাষায় লিখেছেন। তবে সুুমি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন আনসেলম হলো। পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো অনেক সৃষ্টিশীল কবিতা রয়েছে এ গ্রন্থে। রাষ্ট্র ও সমাজের নানান বিষয়ে কবি তাঁর ভাবনা ফুটিয়ে তুলেছেন। পেন্টি সারিকস্কি লিখেছেন,
দুনিয়া বদলাইয়া ফেলা
দর্শনের দায়
নয়
দর্শন বদলাইয়া ফেলাই
দুনিয়ার দায় বরং
তাই আমি হইয়াছি
মার্কস অব্যবসায়ী (পৃ ১৩)
পেন্টি সারিকস্কি ১৯৩৭ সালে ২ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। সুমি ভাষায় তাঁর কবিতার অসাধারণ সম্মান রয়েছে। ইউরোপের নানান ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ হয়েছে। সারা ইউরোপ মহাদেশে সৃজনশীল কবিতার জন্য খ্যাতি রয়েছে তাঁর । তিনি একাধিকবার বামপন্থি মঞ্চ ও দল হতে নির্বাচন করেছিলেন।১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে মনোনয়ন দেয় ফিনিশ পিপলস ডেমোক্রেটিক লিগ। কিন্তু তিনি নির্বাচনে পরাজিত হন।জীবনের এক পর্যায়ে সারিকস্কি ১৯৭৫ সালে স্বেরিয়ায় স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। তিনি ১৯৮৩ সালে ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। ‘যে জীবনাদর্শ গ্রহণ করিয়াছে নিছক তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার আদর্শ-আমি বিদ্রোহী হইয়াছিলাম আমার বাবার বিরুদ্ধে, তিনি যে আদর্শের অনুসারী ছিলেন তাহার বিরুদ্ধে, যেসব প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠা তাঁহার পছন্দের জীবনাদর্শ গড়নে ইন্ধন দিয়াছিল তাহাদের বিরুদ্ধে। ‘ ( পৃ.২৭)
আনসেলম হলো (১৯৩৪- ২০১৩) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত নারোপা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি সুমি ভাষা জানতেন। তিনি ১৯৮৩ সালে ‘পোয়মেস ১৯৫৮-১৯৮০’ নামে পেন্টি সারিকস্কি কবিতার ইংরেজি ভাষায় তর্জমা করেন। বাংলাদেশের বরেণ্য লেখক সলিমুল্লাহ খান ‘পেন্টি সারিকস্কি : উহারা বাতাসে’ নামে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। বইটি মধুপোক হতে মার্চ ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়। কবির মনের আবেগ ও হৃদয়ের স্পন্দন কবিতায় এভাবে প্রকাশ করেছেন। কবি ‘বিরিষ মানুষ’ কবিতায় লিখেছেন,
তুই হইবি মুণ্ডু, মুই হইমু ঠ্যাং।
মুই হইমু মুণ্ডু, তুই হইবি ঠ্যাং।
মুই থাকমু সামনে।
তুই থাকিবি সামনে।
কপালে যাহাই থাকে – আজি এ রজনী
আমাদের খুরের আওয়াজ চলিবে টকটকাটক,
আমাদের দুই চোখে পড়িতেছে ঐ ওয়াদার দেশ।(পৃ.৭)
অনুবাদক সলিমুল্লাহ খান এ বইটির তর্জমার পেছনে কয়েকটি দৈবের যোগ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের সাহসী লেখক ও চিন্তাবিদ মহাত্মা আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের (১৯৩৬-২০১২) কথা উল্লেখ করেছেন। বরেণ্য লেখক সলিমুল্লাহ খান জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৫৮ সালে কক্সবাজার জেলার মহেশখালি উপজেলায় সিপাহিরপাড়া গ্রামে। তিনি ১৯৯৮ সালে ‘আল্লাহর বাদশাহি : ডরোথি জুল্লের নির্বাচিত কবিতা ‘ ইংরেজি হতে বাংলায় অনুবাদ করেন। অনুবাদের ক্রমানুসারে পেন্টি সারিকস্কি : উহারা বাতাসে তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ। বইটির প্রতিটি কবিতায় নানান অর্থ ও অনুভূতি উপলব্ধি করা যায়।
সন্দেহ কি
ফরাশি কবি ঠিকই বলিয়াছিলেন –
আমরা জন্মিয়াছি মানব সংসারে
কিন্তু মরি, আশায় নিরাশ, প্রভুকুল-ছায়াতলে (পৃ.১০৪)
কবিতায় কবির কল্পনা শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কবি তাঁর নিজস্ব ভাবনার জগত ও চিন্তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসার ঘটায়। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন, ‘কবিতার মধ্যে প্রবেশ করিলেই আমরা বুঝিতে পারি মানুষ যতটা না ভাষার স্রষ্টা, তাহার অধিক ক্রীড়নক। ভাষাই মানুষকে মানুষ করিয়াছে। যখন মানুষের ভাষা ছিল না তখন মানুষ মানুষই ছিল না- নিছক প্রাণী ছাড়া কিছুই ছিল না সে। ভাষায় প্রবেশ করার পরই মাত্র মানুষ মানুষ হইয়াছে। শুদ্ধ ভাবনা দিয়া কবিতা হয় না, কবিতা ফলে ভাষায়। কবিতা বিচারে তাই ভাষার কথা বাদ দেওয়া যায় না।'(পৃ.১৮)
ছন্দে ছন্দে কবির মায়াবী কবিতা ও কবিতার কারুকাজ অংকিত হয়েছে। প্রেম ও ভালবাসার সুরের মিশ্রণ ঘটেছে কবিতায়। পাঠকদের হৃদয়ের খোরাক জোগাতে সহায়ক হবে।
তোমাকে ভালবাসি
অচিনদেশের মতন
বড় বড় পাথরের সেতু
বইয়ের গন্ধমাখা সন্ধ্যার মতন
হাঁটি তুমি যেদিকে এই পৃথিবীতে
বায়ুমণ্ডলের তলায়
দুই আলোর মাঝখানে
আমার ভাবনা যাহা ছেনিতে কাটা তোমার দেহের জমিনে (পৃ.৪৩)
বইটিতে পেন্টি সারিকস্কির একটি মুখবন্ধ রয়েছে। যা ‘আমি লেখক আমি সাম্য ব্যবসায়ী’ শিরোনামে লিপিবদ্ধ। মুখবন্ধে কবি সহজ ভাষায় অনেক বিষয়ে লিখেছেন। কবির জীবনাদর্শ ও পরিবারের ধর্মবিশ্বাসের রীতিনীতি তুলে ধরেছেন।
‘প্রাণ লইতে রাজি ছিলাম আমি কিন্তু প্রাণ দিতে নয় – ধ্বংস করিতে রাজি ছিলাম কিন্তু ধ্বংস হইতে নয়।যখন এই মিথ্যার ফাঁদে পড়িলাম, আত্মসমপর্ণ বিনা উপায় রহিল না। সংসারের দেওয়াল হুড়মুড় করিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, আমাকে দাঁড় করাইল সংসারের কর্মযজ্ঞের মুখোমুখি – ঘটনাপ্রবাহ, জনমনুষ্য, শব্দমালা, সৌন্দর্য ও কদর্যতা, প্রতিষ্ঠান আর বিধি ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। হইয়া উঠিলাম সাম্য ব্যবসায়ী – সাম্য ব্যবসায়ী হইব বলিয়া আমি যাত্রা করি নাই।’ (পৃ.২৭) বইটি বাংলা সাহিত্যে পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমি বইটির ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের সফলতা কামনা করছি।
সলিমুল্লাহ খানের উল্লেখযোগ্য বইসমূহ হলো : ১. এক আকাশের স্বপ্ন (১৯৮১) ২.বাংলাদেশ : জাতীয় অবস্থার চালচিত্র (১৯৮৩) ৩.সত্য সাদ্দাম ও স্রাজেরদৌলা(২০০৭) ৪. আমি তুমি সে(২০০৮) ৫. Silence on crimes of power (2009) ৬. আদম বোমা(২০০৯) ৭. আহমদ ছফা সঞ্জীবনী (২০১০) ৮. স্বাধীনতা ব্যবসায়(২০১১) ৯. প্রার্থনা(২০১৯)।
সম্পাদিত :১. ফ্রয়েড পড়ার ভূমিকা (২০০৫) ২.বেহাত বিপ্লব ১৯৭১(২০০৭) ৩.আহমদ ছফার স্বদেশ (২০১৫) ৪. গরিবের রবীন্দ্রনাথ (২০১৭) ৫.অর্থ: আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা পত্রমালা(২০১৮) ৬. প্রাক্সিস জার্নাল(১৯৭৯) ৭. সাহসী মানুষ : মোহন রায়হান ৫০ বছরপূর্তি সংবর্ধনা(২০০৮)
৮. Apostrophe : Working papers of the center for advance theory (2017) ৯. Occasional papers in theory (2016)
সম্পাদিত পত্রিকা :
১. Stamford Journal of Law, numbers 1-3,(2008-2012) ২.আহমদ ছফা বিদ্যালয় (২০১৪) ৩. আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা পত্রমালা ৪.সাম্রাজ্যবাদ বোধিনী।
অনূদিত :১. আল্লাহর বাদশাহি : ডরোথি জুল্লের নির্বাচিত কবিতা(১৯৯৮) ২. সক্রাতেসের তিন বাগড়া(২০০৫) ৩. পেন্টিসারিকস্কি : উহারা বাতাসে (২০২১)।
পেন্টি সারিকস্কি : উহারা বাতাসে ( কবিতা ১৯৫৮- ১৯৮০) , সলিমুল্লাহ খান অনূদিত, প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত, মধুপোক, ঢাকা, মার্চ ২০২১, দাম ৬০০ টাকা।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।