গল্পের বই যে কোন সাহিত্যের অসাধারণ সৃজনশীল ও মননশীল একটি দিক। মানব জীবন নানান সময়ে ভিন্ন ভিন্ন গল্পের সমষ্টি। গল্প শুনতে ভালো লাগে। আবার গল্পের বই পড়তেও আনন্দ লাগে। লেখক মনের কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সহজ- সরল ভাষায় এ বইয়ের গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। যা পাঠকের মনে দাগ সৃষ্টি করে।নিশিনগরী বইটিতে পুনরুত্থান, মনিহারি দিঘি, রাফায়েলের ম্যাটার ও নিশিনগরী নামে চারটি গল্প সন্নিবেশিত রয়েছে। লেখকের স্বতন্ত্র চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে প্রতিটি গল্পে।
বইটির প্রথম গল্পটি হল পুনরুত্থান। এগল্পটি দুই পর্বে আলোচনা করা হয়েছে। পর্ব দুটি হল অনুস্বর ও বিসর্গ। পুনরুত্থান গল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া দেখা যায়। বিশ্ব ভূমণ্ডলে বিচিত্র রকমের প্রাণী রয়েছে। কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে হাজার হাজার প্রাণী নিয়ে এ পৃথিবী। কল্যাণকর প্রাণী যেমন রয়েছে, তেমনি ক্ষতি কর প্রাণীও আছে। এ গল্পে ব্যাঙ ও ব্যাঙের প্রজনন নিয়ে চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে। মানব সমাজের রুপান্তরের প্রক্রিয়াও ফুটে উঠেছে। বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙ আনা হয়েছে দেশে।গল্পের শুরুটা এভাবে, ‘পাশ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত প্রাকৃতিক উপায়ে এবারে আর হাল না হয়ে যাবে না শস্যনাশী পোকামাকড় প্রতিরোধের। কল্যাণ হবে মানুষের। কল্যাণ হবে মাটির। একই সঙ্গে অভিবাসী ব্যাঙগুলোরও। কিন্তু থলথলে ঢিলেঢালা প্রাণীগুলো বংশবিস্তারে যে পোকাদের চেয়েও পারঙ্গম, তা কে জানত?পেস্ট তাড়াবে কি, উল্টো দোজক থেকে উঠে আসা ব্যাঙরূপী শয়তানগুলো একটা সম্প্রসারিত সাম্রাজ্যের পত্তন করে ছাড়ল পাকপোক্তভাবে।’ (পৃ.১১) বাস্তবে মানব সমাজেও এরকম ছদ্মবেশী শয়তানের অভাব নেই। গল্পকার কামরুল হাসান সিদ্দিকী নিজস্ব সৃজনশীলতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নিশিনগরী বইটির লেখক হলেন কামরুল হাসান সিদ্দিকী। বইটি একুশে বইমেলা ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়। এটি অন্যপ্রকাশ প্রকাশ করে। সমাজে হাজারো অসঙ্গতি রয়েছে। লেখক গল্পের মাধ্যমে তা তুলে ধরেছেন। এখানেই লেখকের ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
দ্বিতীয় গল্পটা মনিহারি দিঘিকে নিয়ে। মনিহারি দিঘিকে কেন্দ্র করে লোকমুখে নানান কথা ও প্রথা প্রচলিত প্রচলিত রয়েছে। যুগ যুগ ধরে সমাজে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস বিদ্যমান ছিল। এ গল্পেও কুসংস্কারের দৃশ্য দেখা যায়। মনিহারি দিঘি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দিনদুপুরেই জলজ্যান্ত মানুষকে আত্মসাৎ করার ব্যাপক দুর্নাম আছে খাদক দিঘিটার। অদ্ভুত এক হাঁড়ি ভেসে ওঠে দিঘির তলদেশ থেকে। দেখতে – দেখতেই ফের নিমজ্জিত হয়। তখন একা নয়, সঙ্গে মানুষও নিয়ে যায়। তা সে যত সমর্থ বা বলশালীই হোক। এখানেই থেমে থাকে নি মনিহারি দিঘি। রাতের বেলা একা দিঘির ধারের রাস্তা পেরোনোর সময় দারুণ তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে পথচারী। ‘ (পৃ.৩২) গ্রামীণ জনপদে এরকম বহু জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। অন্ধকারে চলতে অনেকের একা একা ভয় লাগে। ভুত-প্রেতের ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ে। ফলে স্থানীয় অপসংস্কৃতি তথা ঝাড়ফুঁক করে থাকে। গল্পকার এখানে সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার থেকে দূরে থাকার জন্য সর্তক করেছেন।
তৃতীয় গল্পটা হল রাফায়েল ম্যাটার। এ গল্পটা খুবই শিক্ষনীয় বিষয়। স্কুলে নানান বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকুক বা না থাকুক। সিলেবাসের পড়া পড়তে হয়। অভিভাবক কিংবা শিক্ষক বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনে উৎসাহ সৃষ্টি করে। গল্পে রাফায়েলের মোবাইল, কম্পিউটার, ডেস্কটপ ও তথ্য প্রযুক্তির দিকে বেশি আগ্রহী। কিন্তু অভিভাবক বিভিন্ন কারণে এগুলো সীমিত ব্যবহারের পরামর্শ দেন। স্কুলের পড়ার বাইরে রাফায়েল সায়েন্স ফিকশন,অ্যাডভেঞ্চার, কমিকস ও ছোটদের বিজ্ঞান সাময়িকী পড়তে পছন্দ করে। রাফায়েল নানান প্রশ্ন জাগে, ‘পৃথিবীতে নাকি এমন একটা শহর আছে, যেখানে খালি মানুষ আর মানুষ। গিজগিজ করে।যে শহরের লোকগুলো বছরের একটা সময়ে অদ্ভুত এক কাজ করে। ” লেখক এখানে রাফায়েলের প্রশ্নের মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। জানার পরিধি অসীম।
শেষ গল্প হল নিশিনগরী। পরিব্রাজক বা আগন্তুক দেশ থেকে দেশান্তরে পাড়ি দেন। বিভিন্ন দেশের – সমাজের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক কিছু দেখার সুযোগ হয় ভ্রমণকারীদের। ‘তা যত দেশ- দশ সমাজ – সংস্কার দেখেছেন, তাতে বলার মতো ঘটনার অন্ত নেই অতিথি আগন্তুকের অভিজ্ঞতার স্থলীতে। রাতের – পর – রাত পার করে দিতে পারেন, একের – পর- এক বয়ান করে। তবে সারসংক্ষেপে এ যাবৎ যতটুকু বুঝেছেন, তাতে ভারি বিচিত্র এই পৃথিবী। আর সবচেয়ে বিচিত্র পৃথিবীর মানুষ। ‘(পৃ.৮৭)
লেখক কামরুল হাসান সিদ্দিকী ঢাকার আজিমপুরে ১৯৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। নিভৃতচারী এই লেখক বড় হয়েছেন রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু লেখকের চিন্তাশক্তি সুদুরপ্রসারি। তাঁর লেখালেখির চর্চা অনেক আগে থেকেই। লেখকের অন্যান্য প্রকাশিত বইসমূহ : সত্য’র ঘর, আয়নাল হকের আত্মা ও সন্নিহিত সংসারসমূহ, সাক্ষাৎ বাড়ি।
প্রতিবুদ্ধিজীবী’র সম্পাদক ও খ্যাতিমান লেখক নিশিনগরী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘নিশিনগরীতে পূর্বদেশীয় পরিব্রাজকের বহুদূর স্বর্গের সমান্তরাল এক আশ্চর্য নগরীতে প্রবেশ। নগর- সভ্যদের সাথে তার মানসিক সম্পৃক্তি। নগর কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘাত এবং তার পরিণাম, এক অদম্য কৌতূহলের জন্ম দেয়। পরভূমের প্রেক্ষাপটে উত্থান পর্ব গল্পে আধুনিক অর্থনীতিতে মানবিক সম্পর্কের চেয়ে মুদ্রা – ক্ষুধা কীভাবে অবিশ্বস্ত করে তোলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে তাও সফলভাবে বিধৃত।’ বইয়ের প্রতিটি গল্পের কাহিনী মনোমুগ্ধকর ও শৈল্পিকতা প্রকাশ পেয়েছে। লেখক সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান বিষয় গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। আধুনিক সমাজের ধরণ ও মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে দূরে ঠেলে দেয়। বিজ্ঞান এক্ষেত্রে মানব সমাজকে পরিবর্তন ও বাস্তব জীবনকে গতিশীল করে তুলেছে। আমি বইটির ব্যাপক প্রচার – প্রসার ও সফলতা কামনা করছি।
নিশিনগরী, কামরুল হাসান সিদ্দিকী, প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর, অন্যপ্রকাশ, একুশে বইমেলা ২০২২, ঢাকা, মূল্য : ৩৮০ টাকা, পৃ.১২৮.
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।