গত এপ্রিলে হিমছড়ি সৈকত থেকে উদ্ধার মৃত তিমি দুটি বলিনোপেট্রা ইডেনি (ইধষধবহড়ঢ়ঃবৎধ বফবহর) প্রজাতির বলে নিশ্চিত করেছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজি’র (এনআইবি) ডেডিকেটেড রিচার্স টিম। সম্প্রতি বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বুরি) কাছে এনআইবি থেকে প্রেরিত মৃত তিমি দুটির টিস্যু নমুনা বিশ্লেষন প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানান বুরি মহাপরিচালক।
এদিকে সেই মৃত তিমি দুটির কংকাল নিয়ে কক্সবাজারে প্রদর্শনী কেন্দ্র করতে চায় জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। এ জন্য কক্সবাজার সাগরপাড়ে ভাড়ায় সরকারী পরিত্যক্ত ভবন চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি দিয়েছেন বিজ্ঞান জাদুঘরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব মুনীর চৌধুরী। গত ১৮ আগস্ট কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বরাবরে প্রেরিত উক্ত পত্রে বলা হয়, হিমছড়ি সৈকত থেকে উদ্ধার সেই মৃত তিমি দুটির কংকালকে রূপ দিয়ে একটি অস্থায়ী প্রদর্শনীর মাধ্যমে পর্যটক ও স্থানীয়দের কাছে সামুদ্রিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণসহ বøু-ইকনোমির তথ্যাদি বৈজ্ঞানিকভাবে উপস্থাপন করতে চায় জাতীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানটি।
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব মুনীর চৌধুরী স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিজ্ঞান মনষ্কতা সৃজনে প্রতিষ্ঠানটি বহুমাত্রিক ভ‚মিকা পালন করে আসছে। যেখানে বিজ্ঞানের সকল শাখার বিষয়বস্তু নিয়ে ৭টি গ্যালারি রয়েছে। এছাড়া দেশব্যাপী ভ্রাম্যমান প্রদর্শনীর জন্য তাদের ৫টি মিওজু বাস, ৪টি মুভি বাস, ২টি মোবাইল অবজারভেটরি বাস রয়েছে, তবে রাজধানীর বাইরে তাদের কোন কেন্দ্র নেই। কিন্তু কক্সবাজার দেশের একটি পর্যটন কেন্দ্র ও সমুদ্র শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসাবে এখানে বিজ্ঞান যাদুঘরের একটি প্রদর্শনী কেন্দ্র থাকা উচিৎ।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, এবিষয়ে খোঁজ নিয়ে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
গত এপ্রিল মাসের ৯ তারিখ হিমছড়ি সমুদ্র সৈকতে সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে ৪৪ ফুট দীর্ঘ একটি তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে। পরদিন এর এক কিলোমিটার দক্ষিণে প্রায় একই আকারের আরো একটি তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বুরি) বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ এর নেতৃত্বে বুরির বিজ্ঞানীরা মৃত তিমি দুটির নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর সেই নমুনা পরীক্ষার জন্য এনআইবিতে পাঠানো হয়।
বুরি মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর জানান, এনআইবিতে নমুনা প্রেরণের পর তারা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেয় এবং মলিকিউলার বায়োটেকনোলজি বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কেশব চন্দ্র দাশ ও সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. ছলিমউল্লাহর নেতৃত্বে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি ডেডিকেটেড বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে। সেই টিম গত জুলাই মাসে পরীক্ষার রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে বুরির কাছে প্রেরণ করে।
গত ৯ ও ১০ এপ্রিল হিমছড়ি সৈকতে ভেসে আসা মৃত তিমি ২টির জাত ও লিঙ্গ নিয়ে কক্সবাজারের মৎস্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। পরে বিজ্ঞানীরা তিমি দুটো ব্রাইড’স হুয়েল বা বলিন তিমি বলে একমত হলেও লিঙ্গ নিয়ে একমত হতে পারেননি। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা মনে করেন হিমছড়ি সৈকতে ভেসে আসা তিমি দুটির প্রথমটি পুরুষ এবং দ্বিতীয়টি মহিলা, বিএফআরআই’র সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পিএইচডি ফেলো) আশরাফুল হক মনে করেন ঠিক উল্টোটি; মানে প্রথমটি মহিলা এবং দ্বিতীয়টি পুরুষ, আবার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ড. শফিকুর রহমান উভয় তিমি পুরুষ লিঙ্গের বলে মনে করেন।
তবে নমুনা রিপোর্টে প্রথমটি মহিলা এবং দ্বিতীয়টি পুরুষ হিসাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানান বুরি মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডরষফষরভব ঈড়হংবৎাধঃরড়হ ঝড়পরবঃু -ডঈঝ) সর্বশেষ জরীপ মতে, বাংলাদেশে চার প্রজাতির তিমিসহ ১২ প্রজাতির সিটাসিয়ান বা জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণি রয়েছে। বাংলাদেশে থাকা চার প্রজাতির তিমির মধ্যে ব্রাইডিস বা বলিন তিমি (ইৎুফব’ং যিধষব, ইধষধবহড়ঢ়ঃবৎধ বফবহর/নৎুফবর), গন্ডার তিমি বা শুক্রাণু তিমি (ঝঢ়বৎস ডযধষব, চযুংবঃবৎ সধপৎড়পবঢ়যধষঁং), ঘাতক তিমি বা চিতা তিমি (করষষবৎ ডযধষব, ঙৎপরহঁং ড়ৎপধ) এবং ছদ্ম ঘাতক বা নকল চিতা তিমি (ঋধষংব-শরষষবৎ ডযধষব, চংবঁফড়ৎপধ পৎধংংরফবহং ) অন্যতম।
বঙ্গোপসাগরের ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ বিশে^র বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বেশ কয়েকটি তিমিসহ প্রায় এক ডজন স্তন্যপায়ী প্রাণির ‘হটস্পট’ বা আবাসস্থল হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে বঙ্গোপসাগরের ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের ১,৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল বা গধৎরহব চৎড়ঃবপঃবফ অৎবধ (গচঅ) ঘোষণা করেছে। বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এদের হটস্পট হলেও আশেপাশের সাগরেও তাদের বিচরণ দেখা যায় বলে জানান ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন।
বাংলাদেশের সুন্দরবনের ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে ১ কিলোমিটারের বেশি গভীরতাসম্পন্ন একটি সমুদ্র তলদেশীয় আর্ন্তজাতিক খাদ, যা ভারতীয় অংশে ৪০ কি.মি. প্রশস্থ এবং বাংলাদেশে উপকুলে খাদের শেষ প্রান্তে এসে মাত্র ৬ কি.মি. প্রশস্থ হয়ে এর সমাপ্তি ঘটেছে; এই খাদটিই ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ নামে পরিচিত। কক্সবাজার উপকুল থেকে মাত্র দেড়শ থেকে ২শ’ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড।
তবে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ টহরড়হ ভড়ৎ ঈড়হংবৎাধঃরড়হ ড়ভ ঘধঃঁৎব (ওটঈঘ) বাংলাদেশ এর ২০১৫ সালের জরীপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় ৩ প্রজাতির তিমি রয়েছে। এগুলো হলো ব্রাইডিস তিমি, ফল্স কিলার তিমি ও শুক্রাণু তিমি।
বাংলাপেডিয়ার বাংলাদেশের জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাইট- এ একেএম আমিনুল হক (২০১৪) সম্পাদিত তথ্য অনুযায়ী, ১৮৪২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ অঞ্চলের চট্টগ্রাম উপকুলের কাছে একটি তিমি আটকে পড়েছিল, যেটি ইধষধবহড়ঢ়ঃবৎধ গণের অর্ন্তভুক্ত বলিন তিমি বলে শনাক্ত হয়েছিল।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, ডঈঝ এর ২০১৭ ও ২০১৮ সালের জরীপকালে গবেষকরা কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে ব্রাইড’স হুয়েলের মা ও শাবক তিমিকে একসাথে দেখেছেন।