রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যার পর ক্যাম্প সমূহে শোকের আবহ তৈরি হয়েছে। মহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা বড মেয়ে শামীমা, ভাই হাবিব উল্লাহর সাথে, কথা হয়। হাবিব বলেন,আমার ভাই রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সোচ্ছার ছিলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি ছিলেন। মৃৃত্যুর আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের অপ্রতিদ্বন্ধী নেতা ছিলেন। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর বুধবার এশার নামাজ শেষ করে উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের বাসায় আসেন। এর পর খাওয়া দাওয়া শেষ করে পার্শ্বের অফিসে বসে সহকর্মীদের সাথে কথা বলছিলেন, হঠাৎ বন্দুকধারী ২০/২৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী অফিসে বসা লোকজনকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয় তারপর আরসা/ আল ইয়াকিন ক্যাডার মাষ্টার আবদু রহিম ও তার সহযোগীরা ভাই কে লক্ষ্য করে পর পর ৫ রাউন্ড গুলি করে ৪ রাউন্ড গুলির মধ্য তিন টি গুলি লাগে বুকে আর একটি গুলি লাগে হাতে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই বন্দুকধারীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। আমরা লাশ উদ্ধার করে স্থানীয় এম এস এফ হাসপাতালে নিয়ে যাই তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তারপর লাশ ময়না তদন্তের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরদিন লম্বাশিয়া মাঠে জানাজা শেষে দাফন করে থানায় মামলা করি- আমি বাদী হয়ে। এপর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করে ১৪ এপিবিএন পুলিশ। এদিকে তার স্ত্রী নাসিমা বলেন, রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পর মুহিবকে একটা পান এগিয়ে দিলে পান নিয়ে তিনি চলে যান অফিসে।
এর পরের ১০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের অগ্রদূত মুহিবকে তার বাসার পাশে অফিসেই হত্যা করা হয়।
নাসিমা শুধু কাঁদে আর বলে কার কাছে আমরা বিচার চাইব?’-যেখানে মুহিব নাসিমার পাশাপাশি তার ৮ সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বসবাস করতেন। অথচ তিনি চাইলে নিরাপত্তা বেস্টনীর মাঝে উন্নত ভাড়া বাসায় থাকতে পারতেন। তিনি রোহিঙ্গাদের এতই ভালবাসতেন যে বেঁড়ার ঝুপড়ি বাসায় থাকতেন আর রোহিঙ্গাদের সাহস জোগাতেন। তিনি সহকর্মীদের বার বার বলতেন দিন পরিবর্তন হবে মর্যাদার সাথে আমরা স্বদেশে ফিরবোই।
আর্মড পুলিশের নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করছেন মহিবুল্লাহর পরিবার। কিছুক্ষণের মধ্যে বড় মেয়ে শামীমা তার সঙ্গে যোগ দেন। শোকাহত মা-মেয়ের চোখে-মুখে ছিল ভয় আর আতংকের চাপ।
নাসিমা ও তার মেয়ে ঝুপড়ী ঘরটিতে বসে কথা বলছিলেন, সেখানে বাতাস চলাচলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না কোনো বৈদ্যুতিক পাখাও। নাসিমা জানান, বন্দুকধারীদের মধ্যে তিনি ৩ জনকে দেখতে পেয়েছিলেন। তারা বয়সে তরুণ। পরনে ছিল লুঙ্গি। তাদের মুখ ঢাকা ছিল না।
১৯৭৪ সালে জন্ম নেওয়া মুহিবুল্লাহ ছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান।
৩০ ফুট বাই ১০ ফুটের ওই কার্যালয়টি মুহিবের বাসা থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে। সেটি এখন তালাবদ্ধ।
ওই ভয়াবহ রাতের বর্ণনা দিয়ে নাসিমা জানান, রাতের খাবার শেষ করার পর মুহিবের কিছু অনুসারী তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তারা তার সঙ্গে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।এরপর অফিস খুলে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলির শব্দ শুনতে পান তিনি।
নাসিমার বরাতে জানা যায়, মুহিব তখন তার অনুসারীদের বলেছিলেন যে, ভালো দিন আসছে। প্রত্যাবাসনের কাজ দ্রুত শুরু হতে পারে। প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে।
এরপর কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মুহিব তাদের কার্যালয়ের দিকে যেতে বলেন।
মুহিবের ১৮ বছরের মেয়ে শামীমা তখন ঘরের বাইরে গিয়ে দেখতে পান মানুষজন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে।
শামীমা জানান, এরপর তিনি তার বাবার অফিসের দিকে যান। কাছাকাছি পৌঁছাতে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়।
শামীমা বলেন, ‘উঠে দাঁড়িয়ে আমি অফিসে ঢুকে দেখি মেঝেতে লুটিয়ে থাকা বাবার শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমি তার মাথা তুলে ধরি। তখন তার মুখ খোলা ছিল। চোখ দুটি ছিল বন্ধ।
মুহিবের স্ত্রী নাসিমা জানান, তার স্বামীর সঙ্গে ১০ থেকে ১২ জন লোক ছিল। কিন্তু বন্দুকধারীরা গুলি শুরু করতেই তারা পালিয়ে যান।
অভিযোগ করে নাসিমা বলেন, হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পরেও মুহিবকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তার কোনো অনুসারীই এগিয়ে আসেনি।
মুহিবের এই বিশ্বাস ছিল যে, কোনো রোহিঙ্গা কখনো তার ক্ষতি করবে না- এমন মন্তব্য করে নাসিমা বলেন, ‘নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। কারণ তিনি সারাজীবন তাদের জন্য লড়াই করেছেন।’
মুহিব ছিলেন একজন মেধাবী লোক। তিনি মিয়ানমারের আকিয়াব কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। নাসিমার ভাষ্য, মুহিব নিজের পরিবারের চাইতে তার গোষ্ঠীর মানুষের জন্য বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। এসেছি আকিয়াব নামের একটা শহর থেকে। মুহিব উচ্চশিক্ষার জন্য আকিয়াবে আসার পর সে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসে। পরে আমাদের বিয়ে হয়।’
মিয়ানমার সরকার আকিয়াবে রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমিত করার পর তারা আর সেখানে ফিরে যেতে পারেননি।
নাসিমা বলেন, ‘আমার বাবা-মা এখনও সেখানে আছেন। এখানে (আশ্রয়শিবির) আমার দিককার কোনো আত্মীয় নেই।’
মিয়ানমারেও মুহিব রোহিঙ্গাদের নেতা ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে আসার পর তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পান।
নাসিমা বলেন, ‘আমার পরিবারের কোনো সদস্য কিংবা তার (মুহিব) ভাইয়েরা নেতা হওয়ার যোগ্য নন। এ ক্ষেত্রে আমিও কোনো ভূমিকা নেব না।’
এই কথার সূত্র ধরে মুহিবের মেয়ে শামীমা বলেন, ‘নিরাপত্তা ছাড়া আমরা কিছুই চাই না। আমি আমার পরিবারের নিরাপত্তা চাই। আমরা বিচার চাই না। আমি চাই আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হোক।’
বাবার স্বপ্ন পুরণের জন্য আমরা যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি। পথে মহিবুল্লাহর সহকর্মী নুরুল আমিন বলেন, রোহিঙ্গাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরার মতো কোন যোগ্য নেতা নেই। যে কিনা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যা চিহ্নিত করে দেশে বিদেশে তুলে ধরতে পারবেন।তিনি ছিলেন রোহিঙ্গা মুক্তি আন্দোলনের যোগ্য অভিভাবক। মহিবুল্লাহর শিশু সন্তান আফনান (৮)। মানসিক প্রতিবন্ধী এই শিশুর জিজ্ঞাসা, ‘আমার বাবা কোথায় গেছে? কখন আসবে। বাবার অফিস বন্ধ কেন?