নেলসন ম্যান্ডেলা।দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের প্রিয় ম্যাদিবা বা দেশবন্ধু এবং সেদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট। বিশ্ববাসির শান্তিরদূত, মুক্তিকামী মানুষের সাহস এবং অধিকার আদায়ের মিশিলের গগনবিদারী শ্লোগান। বিশ্বের দেশগুলোতে এখন চরমভাবে রাজনৈতিক
অস্থিরতা বিরাজ করছে। সঙ্কটাপন্ন মানবসভ্যতা।অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে জাতিগত সংঘাত,দ্বন্ধ,সন্ত্রাস।
মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে উগ্রজাতীয়তা, বর্ণবাদ। পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশে মানুষ হারিয়ে ফেলছে মুল্যবোধ নীতিনৈতিকতা,সৌভ্রাতৃত্ব।ফলে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মানবতা,অপহ্নত হচ্ছে শান্তি।তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনী গরীবের বৈষম্য।অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে , “বর্তমানে বিশ্বের সম্পত্তির অর্ধেকের বেশি অংশের মালিক মুষ্টিমেয় কয়েকটি করপোরেট হাউসের অধীনে। এর প্রভাব লেগেছে বিশ্বের সমগ্র দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে।ধনী আরও ধনী এবং গরীব আরও গরীব হচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদী লুঠেরা গোষ্ঠীর নতুন নতুন অপকৌশলের গ্যারাকলে মানবসমাজ অশান্তির আগুনে পুড়ছে। মানুষ চায় শান্তির পৃথিবী।মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, বাসযোগ্য ভূমি। বৈশ্বিক এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে, “ম্যান্ডেলাদিবস”এ মানবতার মহানায়ক ম্যান্ডেলাকে স্মরণ করতে গিয়ে বিশ্ববাসী তার মতো একজন গ্রেটনেতার অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভব করছে। যিনি তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা এবং ব্যাক্তিত্ব নিয়ে বহুদা বিভক্ত জাতিগোষ্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে শান্তির পৃথিবী বিনির্মানে ভূমিকা রাখবে।নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিনে পৃথিবীর নিপিড়ীত মানুষের ঘরে ঘরে আজ এটাই প্রত্যাশা।বিশেষজ্ঞ মহল বর্ণবাদ নির্মুল নিয়ে মতামত জানাতে গিয়ে বলেন, ,” বিষয়টি এমন নয় যে,বর্ণবাদ আমাদের সমাজে প্রোথিত আছে। বরং আমরা এটি সমাজে তৈরি করেছি এবং আমরাই তা দূর করতে পারি। ”
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ই জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৩ সালের ৫ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।তিনি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুক্তির জন্য বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন।ত্বক সাদা কিংবা কাল যাহাই হোক না কেন, মানুষের জন্মের অধিকার সবারই সমান। প্রতিটি মানুষেরই রক্তের রং লাল।কবির ভাষায়,কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতর সবারই সমান রাঙ্গা।” কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় রোষানলের স্বীকার হন তিনি ।ফলে ১৯৬৪ সালে একটি সাজানো বিচারের মাধ্যমে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করে কতৃক। ষড়যন্ত্র মামলায় ম্যান্ডেলা দন্ডিত হলে সারা বিশ্বে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন আরোও তীব্র আকার ধারণ করে।ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের প্রতিটি কোণায়।ফলে তিনি হয়ে উঠেন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা। ২৭ বছর কারাভোগ কালীন তিনি ছিলেন আপোষহীন, দৃঢচেতা।সেসময়কার আফ্রিকান সরকার তাকে নানাবিধ প্রলোভনে আপোষে রাজি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।লোভনীয় পদপদবী মন্ত্রী, টাকা, পয়সা সহ বিভিন্ন ভোগবিলাসী প্রস্তাবেও রাজি করাতে পারে নাই শাসক দল।তিনি আন্দোলনকারী কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে মোনাফেকি করে নাই। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি জেলে আটক ছিলেন। শ্বেতাঙ্গ শাসকের নানাবিধ চাপের জবাবে এক চিঠিতে তিনি নিজের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে লিখেন, “নিজের মুক্তি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার জনগণের মুক্তি। আমি আমার জন্ম অধিকার বিক্রি করতে পারি না,যেমন বিক্রি করতে পারি না আমার মানুষের মুক্ত হওয়ার অধিকার। আমি জেলে আসার পর অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন।সেসব সন্তানহীন বাবা-মা, স্বামী হারা বধু ও বাবা হারা সন্তানদের প্রতি আমার ঋণ ভুলে এই মুক্তি আমি চাই না”। এই উক্তির মধ্যেই তার দেশপ্রেম, জাতিগতপ্রেম এবং সমর্থকদের প্রতি ভালবাসার স্বাক্ষর ফুটে ওঠে।২৭ বছর কারাভোগের পর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী মুক্ত হন তিনি। কারামুক্ত হয়ে আফ্রিকান সরকার তার সাথে শান্তি আলোচনায় বসেন। ফলপ্রসূ এক আলোচনার মাধ্যমে সরকার বর্ণভেদ প্রথা রহিত করে।কৃষ্ণাঙ্গদের জন্মগত মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনেন এবং সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভাবে তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ আইন পাশ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন।।তারপর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে সাধারণ নির্বাচনে তিনি ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।এই মহান ব্যক্তিত্বকে সন্মান এবং তার কর্মযজ্ঞ সমূহ চিরস্মরণীয় করতে জাতিসংঘ তার জন্মদিনটিকে ২০১০ সালের ১৮ই জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে “নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস” পালন করার সীদ্ধান্ত গ্রহণ করে।কিন্তু সভ্যতার এই যুগেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদী আচরণ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ,বাস-ট্রেন, স্কুল কলেজ সহ অনেক জায়গায় অনেকের শরীরের রং কালো হওয়ার জন্য নিপীড়ন নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে।
অহিংস নীতির রাজনৈতিক শিক্ষক নেলসন ম্যান্ডেলা । তাঁর ত্যাগ, নেতৃত্ব এবং বিপ্লবী চেতনা বিশ্বের প্রতিটি দেশের নেতাদের অনুসরণীয় ছবক হয়ে আছে।তার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাজনীতিতে নেতা হওয়ার সহজ কোন সূত্র নাই। কঠিন সাধনা, ত্যাগ তিতিক্ষায় পরিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মীরাই নেতা হয়ে উঠেন। ম্যান্ডেলার ভাষায়-“নেতা হওয়ার উদ্দেশ্যে নয়,জনগণের কাজ করে যাও,একদিন জনগণই তোমাকে নেতা বানাবে”।কিন্ত দেখা যায় বর্তমানে নেতা হওয়ার জন্য জনগণের কাছে যাবার প্রয়োজন মনে করে না। নেতার রুপ ধারণ করে,জারির করে, দুই /চার জন দলবদ্ধ হয়ে ব্যানার নিয়ে ছবি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট দিলেই প্রচার, ফলোয়ার, বাহ:বাহ: ইত্যাদি।কমেন্ট বক্সে উপচে পড়ে নানা মুখরোচক বুলি, আগামী দিনের ভবিষ্যত, অভিভাবক, কান্ডারী,চেয়ারম্যান মেয়র সভাপতি সম্পাদক এমপি মন্ত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি। বর্তমানে নেতা হওয়ার জন্য যোগ্যতা কিংবা মেধার প্রয়োজন পড়ে না।টাকা এবং পেশীশক্তি থাকলেই হলো।প্রতিপক্ষকে মাঠে ঘায়েল করতে পারলেই নেতা।তাতেই শক্তিমান পুরুষ। বীরপুরুষ। বড় নেতা।আর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো তেলবাজি, নেতার চামচামি, পদলেহন। অনেকে মনে করে যে, কোন বড় নেতার পাশে দাড়িয়ে দুএক ছবি তুলে পোস্ট করতে পারলেই কেল্লাফতে। সেলফিবাজি এখন রাজনীতির মাঠে বড় রকমের সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে মেধাবীরা এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ রাজনীতি বিমুখ ।
একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রটি রাজনীতিতে আসতো।এখন মেধার মূল্যায়ন হয় না।ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে অনেক অঙ্গ সহযোগী সংগঠনে ভরে গেছে পুরো দেশ।প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সংগঠন, নতুন নাম। নামের শেষে লীগ লাগানো হলেই বেশ।সরকারি দলের মানুষ।
কোন কমিটিই পূর্নতা পায় না।সভাপতি এবং সম্পাদক পরিচয় তুলে ধরতে পারলেই’ হয়ে গেল।তাই নেতায় ভরে গেছে পুরো দেশ ।গতকয়েকদিন আগে একজনের ফেইসবুক টাইমলাইনে দেখলাম, তিনি লিখেছেন, “ভারতের অলিগলিতে প্রোগ্রামার, চীনের অলিগলিতে ইঞ্জিনিয়ার, জার্মানির অলিগলিতে বিজ্ঞানী আর বাংলাদেশের অলিগলিতে নেতা এবং নেতা, সভাপতি বরং সাধারণ সম্পাদক”।রাজনীতিতে সম্পর্কিত একজন মন্তব্যে বলেন, “নেতা নেতা খেলার এই সংস্কৃতি দেশের মানুষের মাঝে রাজনীতির প্রতি নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হবে ।
ভুঁইফোড় মেধাহীন নেতৃত্ব পেটি বুর্জোয়া মানষিকতা তৈরি করে। আর ঘরে ঘরে যদি এই মানষিকপ্রবৃত্তি চেপে বসে তাহলে দেশে শুধু রাজনৈতিক খোলসই থাকবে।সত্যিকারের রাজনীতি যাবে নির্বাসনে”।একজন রাজনৈতিক কর্মী যেখানে বসে কথা বলেন সেটা রাজনৈতিক ক্লাস হয়ে যায়। মানুষ অনুপ্রাণিত হয়।বাংলাদেশে এরকম মানুষের উদাহরণ কম নয়।সেটা কারাগারের ভিতরে হউক কিংবা বাইরে।নেলসন ম্যান্ডলাকে সাগরের গভীরে একটি দ্বীপকে কারাগারে পরিণত করে আটক রাখা হয়েছিল।
নামটি রোবনদ্বীপ। ম্যান্ডেলা রোবনদ্বীপে থাকাকালীন যতজন কয়েদী তার স্পর্শে আসে সবাই তার ভাবশিষ্য হয়ে যায়।তাই পরবর্তী সময়ে এই কারাগার “ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের ১২টি বছর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারাগারে আটক ছিলেন। যে জেলেখানায় বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হতো সে কারাগার হয়ে উঠতো একটি পাঠাগার।
নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনটাই একটি রাজনৈতিক দর্শন। তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি সবসময় সহনশীল ছিলো। ক্ষমতার স্বাদ পেয়েও তিনি এককালের নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেন নাই।প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সবাইকে সাথে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন।করোনা পরবতী বিশ্ব সত্যিকার অর্থে বিবিধ সংকটাপন্ন সময় পার করছে। পৃথিবী এখনো ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত নয়। চারিদিকে যুদ্ধাংদেহী মনোভাব। পরাশক্তি গুলো নিজের শক্তি দেখানো নিয়ে ব্যস্ত।বিজ্ঞানের বদৌলতে নিমেষেই পৃথিবীকে ধ্বংস করার মতো শক্তি আছে অনেক পরাশক্তির হাতে ।তাই সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীর সাধারণ মানুষ ভয়ে তটস্থ প্রতিনিয়ত ।এসে উপলব্ধি করতে পেরে বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে ভাষণে বলেছিলেন , “মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার”।
নানাবিধ কারণে বিশ্ব আজ বহুমুখী সমস্যায় নিমজ্জিত।বিশেষ করে রাজনৈতিক সন্ত্রাসে জর্জরিত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ।বর্ণবাদবিরোধী নেত্রী রাডোফানের মতে,”বর্ণবাদ গনতন্ত্রের জন্য হুমকি। কারণ এটা মানুষ এবং মানবিক মর্যাদাকে আঘাত করে, যা মৌলিক আইন দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে “। তাই মানুষ এখন পরিত্রাণ পেতে চায় বর্ণবৈষম্যের রোষানল থেকে , বেরিয়ে আসতে চায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যতা থেকে, চাপিয়ে দেওয়া কানুন থেকে,অপসংস্কৃতি থেকে, শৃঙ্খল থেকে, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা,মৌলবাদ থেকে। কারণ শান্তিময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন মানুষের মাঝে সাম্য,ভাতৃত্ব এবং মানবিকতা।যে পথ দেখিয়ে গেছেন ম্যান্ডেলা, “মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই”। সব বাধা উপড়ে, ম্যান্ডেলা দিবসে কামনা হোক শান্তির পৃথিবী।ছবকে থাকি, “সবার উপরে মানুষ সত্য”।
লেখক:সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি।
.