মধ্যরাতে আমার ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে পোস্টটি ট্যাগ করেছে সবুজ। গতকাল রাতের ঘটনা বলছি। পোস্টের সারসংক্ষেপ হচ্ছে ফেনীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা শুরু হয়েছে আবার। তখনও নাকি ঘটনাটি চলছে। সবুজ বা আমি আদৗতে জানি না, নির্দিষ্ট এই ঘটনার সত্যতা কতটুকু। সংবাদকর্মী হওয়ার কারণেই আমাকে ট্যাগ করা তার।
সবুজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বাম রাজনীতি করতাম। বিসিএস শেষ করে সবুজ পাল এখন জজ। হ্যা, সবুজ একজন হিন্দু। প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে হিসাব করলে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কমপক্ষে ১৫ বছরের। গতকাল অব্দি কখনও মনে হয় নাই, আমার আর তার মধ্যে সম্প্রদায়গতভাবে একটি পার্থক্য আছে। দুর্গাপুজাকে কেন্দ্র করে চলমান ঘটনা মনে করে দিলো, এই দেশে তার থেকে আমার নিরাপত্তা বেশি।
খ আলী আর রাজী আমার বিশ্ববিদ্যালয়রে শিক্ষক। নাটোরে তার বাড়ি। আশপাশের বাড়িগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের। পুজোর সময় তার বাড়িতে পারিবারিক একটা অনুষ্ঠান চলছিল। ধর্মান্ধরা ধরে নিয়েছিল তার বাড়িতে পুজো হচ্ছিল। তার উপরও হামলা হয়।
কুমিল্লা থেকে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই সংক্রান্ত পোস্টগুলো ইগনোর করছিলাম। চাপমুক্ত থাকার উদ্দেশ্যে। কিন্তু, সবুজের ট্যাগ পাওয়ার পর থেকে হিমশীতল ভয় আমাকে স্পর্শ করতে থাকে। কাল রাতে আর ঘুমোতে পারি নাই, আতঙ্ক আমাকে অস্থির করে তুলছিল। অনেকের কথা মনে পড়ছে। কাঞ্চন’দা, প্রণব’দা, প্রবীর, রিপা, তিন্নীসহ আরও একাধিকজন, যাদের সঙ্গে আমি জীবনের একটা বড়ো সময় কাটিয়েছিলাম। এদের সংস্পর্শে থাকার সময় কখনও মনে হয় নাই আমি অন্য ধর্মের। কিন্তু, চলমান ঘটনাপ্রবাহ আমাদের মধ্যে পার্থক্যটি ধরিয়ে দিলো।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই ধরনের হামলা হঠাৎ করে হয় না। দীর্ঘদিন ধরে ধর্মকে যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে, এরই বহি:প্রকাশ এটি। পরিস্থিতি দেখে অনুমিত হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে কোনো একটা গ্রুপ সাম্প্রদায়িক হামলার এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। বিশেষ কোনো ফায়দা হাসিল করার জন্য। আর তা করা এখন অনেক সহজ। কারণ, এই দেশের মানুষের একটা অংশের মধ্যে ইতিমধ্যে ধর্ম নিয়ে উগ্রপন্থা তৈরি হয়েছে। আমি জানি না, কারা এসব ঘটাচ্ছে।
মাইর খাচ্ছে হিন্দুরা, লুট হচ্ছে তাদের বাড়ি। কিন্তু, আমি কেনো আতঙ্কিত? বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সামাজিক চরিত্র বিশ্লেষণের জায়গায় যাবো না। বহুদিন আগে বিনয় ঘোষ তার মেট্রোপলিটন মন ও মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ বইয়ে তা ভালোভাবেই উল্লেখ করেছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করছেন। নারীদের একটা অংশ স্বাবলম্ভী। নিজদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের উপর মুখাপেক্ষী হতে হয় না।
ধর্মীয় বিধিনিষেধ এখানে অযাচিতভাবে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে চাপানো হয় না। কিন্তু, চলমান উগ্রপন্থার শক্তি এটাই ঈঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি এই রকম নাও থাকতে পারে। এই উগ্রন্থা যদি বর্তমান শক্তি নিয়ে এভাবে চলতে থাকে, তাহলে বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান এ থেকে রক্ষা পাবে না।
আফগানিস্তান এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। নারী বা সর্বোপরি মানুষের স্বাধীনতা বিভিন্ন সময় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশটিতে একটা জায়গায় এসেছিলো। কিন্তু, তালিবান শাসন তা বলতে গেলে আপাতত ধ্বংসই করে দিয়েছে।
আজকে হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু, আগামীতে আপনারা (বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান) এ থেকে রক্ষা পাবেন কি? চোখ বন্ধ করে ঘরে বসে যদি আপনারা ভাবেন আমি তো মুসলমান, ফলে আমার তো কিছু হবে না। এটা ভুল। আপনার চিন্তার স্বাধীনতা ওরা কেড়ে নিবে। মনে রাখতে হবে, চিন্তার শক্তিহীনতার কারণেই মুসলমানরা আজ দুনিয়াজুড়ে পিছনে। সাম্প্রতিকালে বড় কোনো বিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ মুসলমানদের কাছ থেকে খুব একটা আত্মপ্রকাশ করেনি। আপনি যদি আপনার ক্ষমতা সংহত করতে চান, তাহলে জ্ঞানের পরিধি বাড়ান। হিন্দুদের উপর যে আক্রমন, সেটা নিতান্তই শক্তিহীনতার বহি:প্রকাশ। পেশীর এই শক্তি মুসলমানদের চিন্তার বলয়কে আরও দুর্বল করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তালিবানদের পরিস্থিতি। তারা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বানিয়েছে এমন একজন লোককে, যার অর্থনীতি নিয়ে কোনো জ্ঞান নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানিয়েছেন সেই ব্যক্তিকে, যার গবেষণা নিয়ে কোনো ধারণা নাই। বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানরা যদি এখন চোখ বন্ধ করে বসে থাকে, সেই পরিণতিই কিন্তু বরণ করতে হবে।
জামীর রাসেল
১৭.১০.২০২১