১.. তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে
২. একটি পয়সা দাও গো বাবু’
৩. দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কি রে?
৪. এই পেয়েছি অনল জ্বালা
উপরে উল্লেখিত গানগুলোর মতো অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ছিলেন অজয় ভট্টাচার্য (১৯০৬-৪৩)। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শ্যামগ্রামের কৃতী সন্তান । ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুলাই তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন রাজকুমার ভট্টাচার্য । তাঁর মায়ের নাম ছিল শশীমুখী দেবী। রাজকুমার ভট্টাচার্য ছিলেন পেশায় উকিল। তিনি উকালতি করতেন ত্রিপুরা জেলার সদর কুমিল্লায়।
পিতার ওকালতির সূত্রে তাঁর শৈশব কেটেছে ত্রিপুরা জেলা সদর কুমিল্লায়। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায়। , তিনি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ পাশ করেছিলেন।
কলকাতা থেকে ফিরে এসে তিনি কিছুদিন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। এছাড়া তিনি কিছুদিনের জন্যে কুমার বোর্ডিং-এ ত্রিপুরার রাজবাড়ির কুমারদের গৃহশিক্ষক ছিলেন। পরে ওই চাকরি ছেড়ে শচীন দেব বর্মণের আমন্ত্রণে কলকাতায় চলে আসেন এবং কলকাতার বালিগঞ্জের তীর্থপতি ইনস্টিট্যুশনে শিক্ষকতার চাকরি নেন। শিক্ষকতা পেশার অবসরে তিনি চলচ্চিত্রের জন্যে গল্প , সংলাপ ও গান লিখতেন। তাঁর প্রথম গান ‘হাসনুহানা আজ নিরালায়’; গানটিতে সুর দিয়েছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। পরে তাঁর গানে সুর দিয়েছেন সে কালের বিখ্যাত সকল সুরকাররা। বিশেষভাবে তাঁর গানের সুরকারদের তালিকায় পাওয়া যায়- শচীন দেব বর্মণ, পঙ্কজ মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, অনুপম ঘটক, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁর গানগুলো গেয়েছেন শচীনদেব বর্মণ, কে এল সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, কানন দেবী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতিমান শিল্পীরা।
চলচ্চিত্র ও গ্রামোফোন রেকর্ড—উভয় ক্ষেত্রেই সে সময়ে তার লেখা গানগুলো সাড়া জাগিয়েছিল। বাংলা সবাক চলচ্চিত্রের শুরু থেকেই তার গান অনেক প্রচলিত ছিল। তিনি দুই হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। এগুলি পরে কয়েকটি সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে ‘একদিন যবে গেয়েছিল পাখি’, ‘আজো ওঠে চাঁদ’, ‘আমার দেশে যাইও সুজন’, ‘যদি মনে পড়ে সেদিনের কথা’, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গান লেখা ছাড়াও অজয় ভট্টাচার্য চলচ্চিত্রের কাহিনী ও সংলাপ রচনা করেছেন। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সফল ছিলেন। চিত্র পরিচালনায় তিনি দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। তাঁর পরিচালিত ‘অশোক’ ও ‘ছদ্মবেশী’ ছবি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অজয় ভট্টাচার্য নানা বিষয়ে গান রচনা করেছিলেন। এই তালিকায় ছিল কাব্যগীতি, ভক্তিগীতি। সুরের বিচারে এ সকল গানের সুরারোপ হয়েছিল ভাটিয়ালি, বাউল, রাগপ্রধান, কীর্তন ইত্যাদিতে।
অজয় ভট্টাচার্যের অনুজ ছিলেন ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য(১৯০৯-১৯৬৯)। তাঁর জন্ম্ ১৯০৯ সালে কুমিল্লায়। সঞ্জয় ভট্টাচার্য নিজ শহর কুমিল্লায় স্কুল ও কলেজের শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। লিখেছেন গল্প, কবিতা ও উপন্যাস মিলে ৪৭টি বই।
তিনি মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য বার বার শান্তির সংসার থেকে উপস্থিত হয়েছেন অনিশ্চিত সীমান্তে। তবে, পরিবেশ ও পরিস্থিতির চাপে অস্থির হলেও কখনও লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি সাহিত্যসেবী এই মানুষটি। সাহিত্যচর্চা থেকে ‘মডেল ফার্মিং’— সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রতিটি কাজের মূল প্রেরণা ছিল স্বাবলম্বী মানুষ। লক্ষ্য ছিল, সাধারণের সুপ্ত শক্তিকে উসকে দেওয়া। মানুষকে মুক্ত চিন্তার শরিক করে তোলা। সঞ্জয় ভট্টাচার্য নামটি উচ্চারণ করলে তিনটি বিষয় উল্লেখ্যযোগ্য।
১. ‘পূর্ব্বাশা’ (বৈশাখ, ১৩৩৯) পত্রিকার সম্পাদক,
২., কবি, সাহিত্যিক এবং
৩., মানসিক অবসাদগ্রস্ত এক শিক্ষিত সহৃদয় ব্যক্তি, যিনি নিজে হাতে পায়েস রেঁধে প্রিয়জনদের খাওয়াতে ভালবাসতেন।
তিরিশের দশকের শুরুতে বন্ধ হয়ে গেল ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘প্রগতি’-র মতো সাময়িক পত্রিকাগুলো। সে সময় বাঙালি যুবসমাজের মনের কথা প্রকাশের উদ্দেশ্যে কুমিল্লার অখ্যাত চায়ের ঠেক ‘লক্ষ্মী কেবিন’ থেকে প্রকাশিত হল ‘পূর্ব্বাশা’। যেখানে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকার চিন্তা-ভাবনার সমন্বয় সাধন সম্ভব হবে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অজয় ভট্টাচার্য, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, অজিত গুহ, নারায়ণ চৌধুরী, অনিল চক্রবর্তী প্রমুখ তরুণদের উৎসাহ আর ইচ্ছাশক্তিই ছিল ‘পূর্ব্বাশা’-র প্রাথমিক প্রেরণা।
বাংলা সাহিত্যে এই সাময়িক পত্র পূর্ব্বাশা পত্রিকাটি উল্লেখ করার মতো। কুমিল্লার কয়েকজন উদ্যোগী শিক্ষিত যুবকের সাহিত্য অনুপ্রেরণা থেকেই জন্ম নেয় এই পত্রিকা। পূর্ব্বাশা এই নামটি গ্রহণ করা হয়েছিল ঋগ্বেদ-এর একটি সূক্ত থেকে। পূর্ব্বাশা শব্দের অর্থ পূর্ব দিক। ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই পত্রিকা চালু ছিল। এর সম্পাদক হিসাবে অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য। কিছু দিন প্রকাশের বিঘ্ন ছাড়া পুরো সময় কাল জুড়ে এই পত্রিকা বাঙালির মনন চর্চার রসদ জুগিয়েছে। বাংলা সংস্কৃতি জগতের বহু মানুষ এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন লেখার সূত্রে। বাংলা আধুনিক সাহিত্যে এই পত্রিকার অবদান তাৎপর্যপূর্ণ্।
সে দিন তাঁদের কিছুটা বিজ্ঞাপনের ছকে অর্থ সাহায্য করেছিলেন স্বদেশি শিল্পোদ্যোগী শ্রীকাইল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত এবং ইন্দুভূষণ দত্ত।
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য ১৯৩০ এর দশকে কুমিল্লা থেকে এই পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পরে বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে এর প্রকাশস্থান পরিবর্তন করে কলকাতা নিয়ে সেখান থেকে প্রকাশ শুরু করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিখ্যাত কবিদের লেখা এই পত্রিকায় প্রকাশ করা হত।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য ১৯৬৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য-এর বড় ভাই কবি ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য ছাত্রজীবনে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই সূত্রে নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ কাগজে তাঁর প্রথম কবিতা ‘উল্কা’ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি অজস্র কবিতা রচনা করেছিলেন। তাঁর একমাত্র উপন্যাস হলো ‘যেথা নেই প্রেম’। এছাড়া তিনি এরিখ মারিয়া রেমার্কের ‘রোডব্যাক’ উপন্যাস অনুবাদ করেছিলেন।
প্রথম জীবনে তিনি রোমান্টিক গান রচনা করলেও, শেষ জীবনে বহু সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ গান রচনা করেছিলেন। বিশেষত চলচ্চিত্রের গানের সূত্রে তাঁর অনেক গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য গান গুলোছিল ‘এই পেয়েছি অনল জ্বালা’, ‘একটি পয়সা দাও গো বাবু’, ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’, ‘বাংলার বধূ’ গানগুলি তখনকার লোকের মুখে মুখে ফিরত।
অজয় ভট্টাচার্যের জীবিত অবস্থায় তাঁর গানের তিনটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হলো ১. ‘আজি আমারি কথা’, ২. ‘মিলন-বিরহ-গীতি’ ও ৩. ‘শুক-সারী’। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ‘আজও ওঠে চাঁদ’।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর স্ত্রী রেণুকা ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘অজয় ভট্টাচার্যের গান’।
কবি অজয় ভট্টাচার্য ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
-জয়নাল হোসেন
লেখক ও গবেষক।
২৫.০৯.২০২০
সাহিত্যে সাথে জডিত মানুষগুলি অতি সহজ সরল।