সংগীতগুণীরা বলেন, খাঁটি লোকসংগীতের সুর কখনও নির্দিষ্ট থাকে না, উৎস থেকে বেরিয়ে বহতা নদীর মতো এঁকেবেঁকে ফুলেফেঁপে বয়ে চলে। চলার সময় সেই সুরনদী প্লাবিত করে দুকূল— সেই প্লাবনে সৃষ্টি হয় নতুন সুর, নতুন গান। কালের প্রবাহে লোকসংগীত ভেঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক কিংবদন্তী শিল্পী অসংখ্য চিরসবুজ গান সৃষ্টি করেছেন। লোকসংগীত-রঞ্জিত এসব গানকে ‘চৌর্যবৃত্তি’র (নকল বা চুরি) পর্যায়ে ফেলা যথার্থ নয়।
শিল্পে ‘চৌর্যবৃত্তি বা ‘অনুকরণ-অনুসরণ’ নতুন কিছু নয়, নতুন নয় তা চাটগাঁইয়া গানেও। কিন্তু চৌর্যবৃত্তি আর অনুকরণ-অনুসরণ এক জিনিস নয়। অন্য কারও সৃষ্টি লাইন বাই লাইন কপি না করলে তাকে ‘চুরি বা ‘নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া’ বলা যায় না। শিল্প-সাহিত্যে চৌর্যবৃত্তি অবশ্যই গর্হিত কাজ, কিন্তু অনুকরণ-অনুসরণকে এই কাতারে ফেলা যায় না, ফেললে অনেক কালজয়ী সাহিত্য-সংগীত এবং সেসবের স্রষ্টাকে বাতিল করতে হবে।
চাটগাঁইয়া সংস্কৃতিতে অনুকরণ ও অনুসরণ-চেষ্টায় সৃষ্ট অসংখ্য গান কালজয়ী গান হিসাবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে, সাংগীতিক পরিভাষায় সেসব গানকে বলা হয় ‘ভাঙা-গান’। দেশি-বিদেশি যেসব গান শিল্পীরা নিজে বা অন্য কারোর কাছে শুনে মুগ্ধ হয়ে সুর-কাঠামো অনেকাংশে ঠিক রেখে তাতে বাণী বসিয়েছেন— সেগুলিকেই ভাঙা-গান বলা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ডিএল রায়, শচীন দেববর্মণসহ সংগীতের অনেক বরপুত্র অন্যের গান অনুসরণ করে ভাঙা-গান সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো আজ বাঙালির প্রাণের গান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাঙা-গান আছে ২৩৩টি। মধ্বয়সে বাংলা গ্রামীণ গান ভেঙে অনেকগুলি গান বানান রবীন্দ্রনাথ। এ ক্ষেত্রে তাঁর কালজয়ী গানটি হলো— ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ লালন-শিষ্য গগন হরকরার সর্বশ্রেষ্ঠ গান ‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি ভেঙ্গে রবিঠাকুর এই অমর দেশাত্মবোধক গানটি সৃষ্টি করেছেন। যেটি আজ আমাদের জাতীয় সংগীত।
চাটগাঁইয়া গানে উল্লেখযোগ্য ভাঙা-গান হলো লোকসংগীতের প্রবাদপুরুষ কবিয়াল রমেশ শীলের ‘আঁধার ঘরত রাইত কাডাইয়ম কারে লই’, খায়েরজ্জামা পণ্ডিতের ‘বানারশি গামছা গায় ভগ্নির’, মলয় ঘোষ দস্তিদারের ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি’ এবং ‘ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান’, মোহন লাল দাশের ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের ‘ওরে নুরানী বালা’ এম এন আখতারের ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে’, আবদুল গফুর হালীর ‘বানুরে, জি জি জি’, ‘ ন মাতাই ন বুলাই গেলিরে বন্ধুয়া’, সনজিত আচার্যের ‘কি গান মাঝি হুনাইল’ ইত্যাদি।