সাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে সংঘবদ্ধ জলদস্যূদের কবলে পড়েছিল কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাাড়ি এলাকার আনোয়ার কামালের ফিশিং ট্রলার। এসময় ১২/১৩ জন দস্যূ আনোয়ারের ট্রলারের মাছ, জালসহ মূল্যবান মালামাল লুট করে নিয়ে নেয়। তা নিকটে অবস্থান করে প্রত্যক্ষ করেছিল আরও কয়েকটি ট্রলারের জেলে। যেসব ট্রলারের জেলেরা এক যোগে জলদস্যূদের ট্রলারের দিকে এগিয়ে গেলে দস্যূরা এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করতে থাকতে। এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে গেছে জেলেরা ৪ টি ট্রলার যোগে এক যোগে হানা দেয় দস্যূদের ট্রলারে। অনন্ত ৬০ জেলে দস্যূদের মারধর করে হাত-পা বেঁধে দস্যূদের হিমঘর বা কোল্ডস্টোরেজে বন্দি করে। একই সময় আনোয়ারের ফিশিং ট্রলার থেকে লুট করা মালামাল নিজের ট্রলারে নিয়ে নেয় জেলেরা। এরপর দস্যূদের ট্রলারটি অর্ধেক ডুবিয়ে ক‚লে ফিরে যায় জেলেরা।
চলতি বছরের ৯ এপ্রিল বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী-কুতুবদিয়া উপক‚লের মাঝামাঝি এলাকায় এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়। এর ১৪ দিন পর ২৩ এপ্রিল গুরা মিয়া নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধিন একটি ট্রলার সাগরে ভাসমান থাকা আর এক ট্রলার নাজিরারটেক উপক‚লে নিয়ে আসে। আর ওই ট্রলারের হিমঘরে হাত-পা বাঁধা ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ২৫ এপ্রিল নামবিহীন ওই ট্রলারটির মালিক (যিনি নিহতদের একজন) সামশুল আলম প্রকাশ সামশু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাদি হয়ে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৬০ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন।
এ মামলায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ধরে পুলিশ এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। যে ৯ জনের কাছে প্রাপ্ত তথ্য, পুলিশের কাছে দেয়া ১৬১ ধারার জবানবন্দি ও আদালতে দেয়া ৭ জনের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে হত্যার পুরো ঘটনাটি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
এ ঘটনায় সর্বশেষ ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মহেশখালীর সোনাদিয়া এলাকার মৃত মোস্তাক আহমদের ছেলে দস্যূ সর্দার খাইরুল বশর সুমনের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। সমুন প্রথম দফায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পনকারি জলদস্যূদের একজন।
সুমনকে ৬ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সদর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গাঁ ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ৪ দিনের রিমান্ড শেষে সুমনকে সোমবার বিকাল ৪ টার দিকে আদালতে হাজির করা হয়। বিচারক আখতার জাবেদের আদালতে সন্সাড়ে ৭ টার দিকে সুমনও ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রদান করেছে বলে আদালত সূত্রে নিশ্চিত করেছেন।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক (গোয়েন্দা) দুর্জয় বিশ্বাস ৪ দিনের শেষে খাইরুল বশর সুমনকে আদালতে হাজির করা হলে ওখানে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রদানের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
তবে তিনি ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে কি বলেছেন তা জানেন না বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেছেন, ট্রলারে ১০ মরদেহ উদ্ধারের মামলার পুরো ঘটনা পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। সুমন সহ গ্রেপ্তার ৯ জনের কাছে প্রাপ্ত তথ্য মতে ১২/১৩ জনের একটি দল সামশুল আলম প্রকাশ সামশু মাঝি (যিনি নিহতদের একজন) ও নুরুল কবিরের (যিনিও নিহতদের একজন) নেতৃত্বে সাগরে গিয়েছিল ডাকাতি করতে। যার জের ধরে ক্ষুব্ধ জেলেরা পিটিয়ে হত্যা করে তাদের। এ ঘটনায় আনোয়ার কামালের ট্রলারের জেলে ছাড়াও আবছার, আমান ও বাবুল মাঝির ট্রলারের জেলেরা হামলায় অংশ নিয়েছিল। যেখানে অনন্ত ৬০ জন জেলে হামলায় অংশ নেয়।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার ৯ জনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনায় অংশ নেয়া ২৫ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। যাদের ঠিকানা যাচাই-বাছাই এবং গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত আনোয়ার কামালকে গ্রেপ্তার করা সক্ষম হয়নি। আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করা গেলে ঘটনাটি আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
আর সাগরে ডাকাতির এই পুরো ঘটনাটির জন্য পুলিশের ভাষা ‘ অন্যতম মাস্টারমাইন্ড’ আত্মসমর্পনকারি দস্যূ খাইরুল বশর সুমন মিয়া। সাগরে না গিয়ে দস্যূদের অস্ত্র যোগানদাতা তিনি। গত ২৩ এপ্রিল কক্সবাজারের নাজিরারটেক সংলগ্ন ভাসমান একটি ট্রলারের হিমাগার থেকে অর্ধগলিত ১০ মরদেহ উদ্ধারের পর সুমন আত্মগোপনে ছিলেন। সাড়ে ৪ মাস পর সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারের পরপরই সুমন পুলিশকে বলেছিল ‘আমি ডাকাতি করতে পাঠিয়েছিলাম, তাদের মরতে পাঠায় নাই।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক (গোয়েন্দা) দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, সুমন অনেক শক্ত হৃদয়ের মানুষ। বার বার বলেছে, ‘আমি ডাকাতি করতে পাঠিয়েছিলাম, তাদের মরতে পাঠায় নাই।’ অথচ সুমন এটা স্বীকার করেছে যে সামশু মাঝি ও নুরুল কবির ট্রলারে ডাকাতি করতে পাঠানো লোকজন তারই লোক ছিল।
পুলিশের সূত্র মতে, এক সময় সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার খাইরুল বশর সুমন বংশ পরম্পরায় ১৪ বছর বয়সে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। এরপর জড়িয়ে পড়েন দসূতায়। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমপণ করেন অনেক দস্যূ। তাদের একজন সুমন। ২০১৯ সালে জামিনে মুক্তি পান সুমনসহ দশ আত্মস্বীকৃত দস্যূ। তবে ২০২১ সালে বেজার অধিগ্রহণকৃত জমির দখল ঘের তৈরী ও অপর মারামারির একটিসহ দুটি মামলায় ফের গ্রেপ্তার হন সুমন। এর কয়েক মাস পর জামিনে বেরিয়ে পুনরায় দস্যূতার ফের জড়িয়ে যান।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক (গোয়েন্দা) দুর্জয় বিশ্বাস জানান, সমুন ছাড়াও ১০ খুনের ঘটনায় ৮ জনের মধ্যে ৬ জন ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রদান করেন। এরা হলেন, মামলার এজাহারের প্রধান আসামি বাইট্টা কামাল, বাঁশখালীর বাসিন্দা ফজল কাদের মাঝি ও আবু তৈয়ুব মাঝি, মহেশখালী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খায়ের হোসেন, চকরিয়ার বদরখালী এলাকার মো. নুর নবীর ছেলে গিয়াস উদ্দিন মুনির, মাতারবাড়ী ইউনিয়নের সাইরার ডেইল এলাকার এস্তেফাজুল হকের ছেলে দেলোয়ার হোসেন। তবে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড শেষেও মামলার ৪ নম্বর আসামি করিম সিকদার ও বাইট্টা কামালের ভাই ইমাম হোসেন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেননি।
তিনি জানান, এ ঘটনার তদন্ত অনেকটা গুছিয়ে এসেছে। তদন্তে হত্যাকান্ডে জড়িত ২৫ জেলের তালিকা পেয়েছে। অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিলের প্রস্তুতি চলছে। তবে ঘটনায় নাম আসা জেলে এবং আনোয়ার কামালকে গ্রেপ্তার করা গেলে আরও পরিষ্কার হওয়া যাবে। তাদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে।