কক্সবাজারে অসহায়, দরিদ্র ও অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের মাঝে শিক্ষার আলো জাগ্রত করেছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা “স্কাস” পরিচালিত শিখন স্কুল। টাকার অভাবে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠদানের মাধ্যমে অনন্য ভূমিকা রাখছেন স্কাসের শিখন স্কুল।
কক্সবাজার পৌরসভাসহ জেলার তিনটি উপজেলায় তাদের ৩১০ টি কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ হাজার ৩০০ জন। শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রতিমাসে রয়েছে উপবৃত্তির ব্যবস্থাও।
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত পাঠ দান করছেন প্রশিক্ষিত শিক্ষক। এসব স্কুলের শিশুরা কেউ ডাক্তার, কেউবা আদর্শ শিক্ষক, আবার কেউ বড় সরকারি অফিসার হওয়ার স্বপ্নও দেখছে। এসব এলাকায় স্কুল-কলেজ থাকলেও প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ের অবহেলিত শিশুদের স্কুলে লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কেউ কেউ স্কুলে গেলেও অর্থের অভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী প্রাথমিকের গণ্ডিও পার হতে পারেনি। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে শিখন স্কুল। বাচ্চারা এখন ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যায়।
স্কাসের দেওয়া তথ্য বলছে, ‘এ কর্মসূচির আওতায় দুই ধরনের পাঠ পদ্ধতি রয়েছে। যার মধ্যে স্কাস কোহাট পদ্ধতি বাস্তবায়ন করছে। শিখন স্কুলে একটি নির্দিষ্ট কারিকুলাম অনুযায়ী লেখাপড়া হচ্ছে। শিখন কেন্দ্রে রয়েছে ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে ৩ বছর মেয়াদি প্রারম্ভিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। স্কাস শিখন কেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে কক্সবাজার পৌরসভায় ১০০ ও সদরে ৭০টি মোট স্কুলের সংখ্যা ১৭০টি। এসব কেন্দ্র শিক্ষক রয়েছেন ১৭০ জন। যেখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ হাজার ১০০ জন। এসব স্কুল দেখা-শোনা করার জন্য রয়েছে সুপারভাইজার, উপজেলা ম্যানেজার, মনিটরিং ১ জন এবং জেলা ম্যানেজার রয়েছেন ১ জন। পৌরসভায় ১০০ স্কুলের মধ্যে শিক্ষার্থী রয়েছে ৬ হাজার। যারমধ্যে ছাত্রী ৩ হাজার ২৯৮ জন এবং ছাত্র ২ হাজার ৭০২ জন। এসব স্কুলে প্রতিবন্ধীসহ দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সরকারিভাবে বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়। শিক্ষার অন্য সকল উপকরণ দিয়েছে স্কাস। শিশুদের স্কুলমুখি করতে শিখন স্কুলে নেওয়া হয়েছে কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ’।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুখর থাকে শিখন স্কুল। শিক্ষকের সাথে সাথে পড়ছেন শিক্ষার্থীরাও। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন শিক্ষকরা। ছবি আঁকা, গল্প বলা ছাড়াও বিভিন্ন জীবজন্তুর ছবি দেখিয়ে শেখানো হচ্ছে তাদের।
স্কাসের উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার আব্দুল হালিম জানান, ‘নানা কারণে ও আর্থিক অনটনে লেখাপড়া বন্ধ করে কাজে যোগ দিয়েছিল অনেক শিশু। এখন তারাই বাড়ির পাশেই শিখন স্কুলে পড়ালেখা করছে। শিখন স্কুল না হলে এখানকার ছিন্নমূল শিশুরা পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত। এই স্কুলের পাঠদান পদ্ধতি আনন্দময় হওয়ায় শিশুরা নিয়মিত স্কুলে আসে। কোন শিক্ষার্থী যদি স্কুলে না আসে শিক্ষক অনুপস্থিত ছাত্রের বাড়ি গিয়ে তার স্কুলে না আসার কারণ জানতে চায়। এতে করে অভিভাবকরাও উৎসাহিত হন’।
স্কাসের জেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার জায়েদ নূর জানান, ‘শিক্ষকদের ১২ দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাঠদান-উপযোগী করে শিখন স্কুলে শিশুদের আনন্দের সাথে পাঠদান করা হয়। পাঠদান প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের রয়েছে বিশেষ কৌশল। পাশাপাশি এঁরা সংগীত, সাহিত্য, ছবি আঁকা ও বিভিন্ন স্কুলের খাতাপত্র, বই, কলমসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্কাস থেকে দেয়া হয়। এতে প্রাথমিকে ঝরে পড়া রোধ হচ্ছে’।
বিজিবি ক্যাম্প এলাকার ৬১ নং সেন্টারের শিক্ষিকা বুলবুল আক্তার বলেন, সকাল এবং বিকেলে দুই শিফটে ভাগ করে পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা ঠিকমত স্কুলে চলে আসে। কেউ কোন কারণে না আসলে তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয়।
আলির জাহাল এলাকার ৫১ নং সেন্টারের শিক্ষিকা নুর কলিমা জানান, ‘ এসব স্কুলে চাকরি করতে গিয়ে কখনো বেতনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। সঠিক সময়ে বেতন পেয়েছি।
মধ্যম কুতুবদিয়া পাড়ার ৩১ নং শিখন স্কুলের শিক্ষিকা ফরিদা ইয়াছমিন বলেন, ‘ ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করা হয়। সবাই মনোযোগ সহকারে পড়ালেখা করছে। প্রতিদিন ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসা বাধ্যতামূলক।
শিশু শিক্ষার্থীরা বলেন, স্কুলে পড়ালেখা করতে তাদের খুব ভালো লাগে। শিক্ষকরা তাদের খুব আদর যত্ন করে পড়ায় এবং কোন কিছু না বুঝলে তাদের মত করে বুঝিয়ে দেয়। অনেকের বাড়ির আশেপাশে স্কুল থাকলেও অসচ্ছলতার কারণে স্কুলে যেতে পারে না অনেক শিক্ষার্থী। এখন শিখন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তারা পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছেন। তাদের দাবি, শিখন স্কুল যেন কখনো বন্ধ হয়ে না যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘এসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কৃমিনাশক ট্যাবলেট ও আইরন ট্যাবলেট খাওনোর কর্মসূচি চালু রাখা হয়েছে। এতে অভিভাবকরা আগ্রহী হচ্ছেন এবং শিশুরা পড়ালেখায় আরও মনোযোগী হচ্ছে। শিখন স্কুলে একজন শিক্ষক ৩০-৩৫ জন শিশুর জন্য কমিউনিটি প্রদত্ত ঘরে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবানে শিক্ষা ও সাক্ষরতার হার কম। এ বিবেচনায় এ অঞ্চলের শিশুদের স্কুলমুখী করতে সরকারের এ প্রকল্প অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ মহল। আগে যেসব শিশু স্কুলে যেত না, তারা এখন স্কুলে এসে মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে।
সমাজ কল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস) চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা বলেন,’ শিশুদের বিনামূল্যে ব্যাগ, খাতা, কলম, পেন্সিল, স্কুল পোশাকসহ শিক্ষা উপকরণ দিয়ে এসব শিশু শিখন কেন্দ্রে বিনামূল্যে পড়ানো হয়। প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি এসব পাঠশালায় শিশুদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চাও করানো হয়’।
তিনি বলেন, ‘সরকারের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আউট অব স্কুল চিল্ড্রেন প্রকল্প(পিইডিপি-৪) এর আওতায় কক্সবাজারের ৩১০ টি শিখন কেন্দ্র পরিচালনা করেন তাঁর সংস্থা। শিশুদের শিক্ষার আলোতে নিয়ে আসতে কাজ করছেন তিনি। এছাড়া পোশাক, স্কুল ব্যাগ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসে পৌরসভায় ৩০০ টাকা ও সদরে ১২০ টাকা করে উপবৃত্তির টাকাও পেয়ে থাকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো জেলার সহকারি পরিচালক একেএম বজলুর রশীদ তালুকদার জানান, ‘শিখন স্কুল আউট অব স্কুল এডুকেশন প্রোগ্রাম (পিইডি-৪) প্রকল্পের একটি প্রজেক্ট। কক্সবাজার পৌরসভাসহ জেলার তিনটি উপজেলায় এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ৩১০ প্রতিষ্ঠানে ১২ হাজার ৩০০ ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করছে। যারা কখনো স্কুলে যায়নি অথবা কোনো না কোনো কারণে ঝরে পড়েছে তাদের জন্য সরকার ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর এটি চালু করে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘এক বছরের সিলেবাস কে ৬ মাসে নিয়ে আসা হয়েছে। যে সময়টা নষ্ট হয়েছে সেটা বাঁচিয়ে শিক্ষার মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব শিশুদের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছে’। তিনি বলেন, ‘ এঁরা তো অন্ধকারে ছিল! সেখান থেকে আলোতে আনা হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে তাদেরকে স্কিল ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া। ইতিমধ্যে ৩০০ শিশুকে প্রাথমিকে ভর্তি করার উদ্যোগ নিয়েছি। এসব শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার হার ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মনে করছেন।
বজলুর রশিদ আরও বলেন, ‘কক্সবাজার পৌরসভা সহ ৩ উপজেলায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভায় ১০০ টি কেন্দ্র, সদর, রামু ও চকরিয়ায় উপজেলায় ৭০ টি করে মোট ২১০টি কেন্দ্র সহ সর্বমোট ৩১০ টি কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ হাজার ৩০০ জন। প্রকল্পটি মুলত ঝরে পড়া শিক্ষার্থী বা যারা কখনো স্কুলে যায়নি তাদের টার্গেট করে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগ’।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘শিখন স্কুল কার্যক্রমটি প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পুণরায় স্কুলগামী করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।