আজ বিশ্ব প্রাণী দিবস। ভূমি জরিপে কক্সবাজারের ৪০ শতাংশই বনভূমি। এ বনেই রয়েছে তিনটি জাতীয় উদ্যান,দেশের প্রথম সাফারি পার্ক ও সংরক্ষিত বন। এসব উঁচু-নিচু, পাহাড়ি টিলায় বুনোহাতিসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী,পাখ-পাখালী ও সরিসৃপের বসবাসছিল। যার অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বনাঞ্চল উজাড় ও বনভুমি দখল হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে বুনোহাতি। প্রায় প্রতিদিন কক্সবাজারের সাত উপজেলার কোথাও না কোথাও বুনোহাতি খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে ছুঁটে আসছে। এতে নানাভাবে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ছে বুনোহাতি।
গত মাসে টেকনাফ উপজোর হ্নীলা ইউনিয়নের শালবন পাহাড়ে ছয়দিনের ব্যবধানে বিপন্ন দুটি হস্তিশাবকের মৃত্যু হয়েছে। বনবিভাগ হাতি দুটির মৃত্যু দুই কারণে হয়েছে বলে মনে করছে। বনবিভাগ ও পুলিশ জানায়, গত শনিবার(২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে শালবন পাহাড়ের ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ি ঝিরিতে একটি বন্যহাতির শাবকের মৃতদেহ পাওয়া য়ায়। একই এলাকায় ছয়দিন আগে(২০ সেপ্টেম্বর) আরো একটি হাতির শাবকের মৃত্যু ঘটেছিল।
বনবিভাগের টেকনাফ বিট কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক আহমেদ বলেন, খাদ্যের খোঁজে বিচরণের সময় পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে এদের মৃত্যু হতে পারে। নতুবা ওই পাহাড়ি এলাকায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধাওয়া বা গুলি খেয়ে মৃত্যু হতে পারে। হাতি দুটির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে এবং মরদেহের নমুনা সংগ্রহ করে ময়না তদন্তের জন্যে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে (৩১ আগস্ট) পাশের রামু উপজেলার খুনিয়া পালং এলাকায় বৈদ্যুতিক তারে ফাঁদে ফেলে আরও একটি বন্য হাতি হত্যা করা হয়েছিল। এ নিয়ে গত চার বছরে বিদ্যুতিক শক,চোরাশিকারীদের গুলি ও নানা কারণে কক্সবাজারের বনে ১৯টি বুনো হাতির মৃত্যু হয়েছে বলে বনবিভাগ সূত্র জানায়। গত বছরের নভেম্বর মাসে চকরিয়া ও রামু উপজেলায় গুলিতে ও বৈদ্যুতিক শকে ১২ দিনের মাথায় তিনটি হাতির মৃত্যু হয়েছিল। এসব হাতির মৃত্যু নিয়ে থানায় মামলা হলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।
কক্সবাজারের পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রণমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন আজকের পত্রিকাকে জানান,গত চার বছরে তিন উপজেলায় রোহিঙ্গা বসতি,সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি ও নানাভাবে প্রায় ২০ হাজার একর বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে।
পথ হারা বন্য হাতি:
চার বছর আগে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার বনভুমিতে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্যে বন হাতছাড় হয়। এ ছাড়া পাহাড়ি জমিতে মানুষের বসত বেড়ে যাওয়া এবং বনভূমিতে সরকারি কয়েকটি দপ্তর ও রেললাইনসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে হাতি চলাচলের করিডর নষ্ট হয়ে পড়েছে। এতে হাতির দল পথে পথে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
সরেজমিন চকরিয়া ফাঁসিয়াখালীর প্রাকৃতিক বন ঘুরে দেখা যায়, কোথাও টিলা কোথাও সমতল এবং ঝোঁপ জঙ্গল সমৃদ্ধ এ বন থেকে ছোট-বড় অসংখ্য ছড়া-খাল নেমেছে এক সময়ের বিলুপ্ত সুন্দরবনে। পাহাড় স্নাত মিঠাপানি ও সামুদ্রিক জোয়ারের সংমিশ্রিত হালকা নোনা পানি ছিল বন্যহাতির খুবই পছন্দের।
সেই পছন্দের জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে হাতির অভয়ারণ্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল বনবিভাগের। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সেখানে দুটি পরিখাসহ হাতির পছন্দের বন সৃজন করা হয়েছে। কিন্তু এখন সেই অভয়ারণ্য দিয়ে যাচ্ছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন। একইভাবে কক্সবাজারের ঈদগাঁও,রামু,কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় এভাবে হাতির চলাচল পথ রুদ্ধ হয়ে আসছে।
ফাঁসিয়াখালীর বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক ইবরাহীম মুহাম্মদ বলেন, ফাঁসিয়াখালীর বনাঞ্চল বন্যহাতির পছন্দের আবাসস্থল। বন্যহাতিরদল এ বনে ও পাশের নোনা পানিতে ডেরা গড়ে তুলতো।এক সময় এখান থেকে মিয়ানমার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগামের পাহাড়ে অবাধ বিচরণ ছিল বন্যহাতির। বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম জানান, হাতির আবাসস্থল বাড়াতে বনবিভাগ নানা উদ্যাগ গ্রহল করেছে। বিশেষ করে ডুলাজারা,খুটাখালী,মানিকপুর-সুরাজপুর ও কাকারার বনাঞ্চলে হাতির পাল নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করতে বনকর্মীরা কাজ করছে।
হাতি ও মানুষের সংঘাত কমাতে বনবিভাগের প্রকল্প: সর্বশেষ ২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এর জরিপে দেখা যায়, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় ২৪৮টি এশিয়ান হাতির বসবাস রয়েছে। এই জরিপে হাতি চলাচলের ১২টি করিডোর চিহ্নিত করা হয়।
এসব করিডোর দিয়ে হাতি খাদ্যের সন্ধানে এক জায়গা আরেক জায়গা ঘুরে বেড়ায়। হাতিরদল এসব করিডোরে দখল ও স্থাপনা নির্মাণ হওয়ায় আক্রমণাক্তক হয়ে উঠেছে। এ দ্বন্দ্ব নিরসনে বনবিভাগ স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের সম্পৃক্ত করে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বনবিভাগ হাতির অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণও করার পরিকল্পনা করছে। হাতির চলাচল ও আক্রমণে প্রাণ ও ফসলহানির ঘটনায় বনবিভাগ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। বনবিভাগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক আবদুল আওয়াল সরকার বলেন, ২০২০-২১ অর্থ বছরে চট্টগ্রাম বন অঞ্চলে ১৩টি হাতি মারা গেছে। এ সময়ে হাতির আক্রমণে ২১জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই অর্থ বছরে হাতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে এক কোটি ১৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
দুই বছরে ২০টি হাতির বাচ্চা: জেলার টেকনাফ,উখিয়া ও রামু বনে হাতির এ সংকটময় সময়ে সুখবর দিয়েছে বনবিভাগ। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় বনকর্মকর্তা(ডিএফও) মোহাম্মদ সারওয়ার আলম গত দুই বছরে ১৫টির মতো হাতি বাচ্চা দেওয়ার তথ্য দিয়ে জানান, এ তিন উপজেলায় হিমছড়ি, ধোয়াপালং, পানের ছড়া, ইনানী, হোয়াইক্যং, শীলখালী রেঞ্জের বনাঞ্চলে এসব হাতির বাচ্চা জন্ম হয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে প্রায় ৭৪০ একর বনভূমিতে হাতির জন্য নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডর উন্নয়ন করা হয়েছে।
কক্সবাজারের প্রকৃতি গবেষক ও সাংবাদিক আহমদ গিয়াস জানান, কোন সমীক্ষা ছাড়া বনের আশপাশে উন্নয়ন ও স্থাপনার কারণে হাতির চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে নির্বিচারে পাহাড় দখল ও বন উজাড়ের ফলে হাতি ও বন্যপ্রাণী বিলু্প্ত হতে বসেছে। #