আমার শৈশব থেকে যতটুকু মনে করতে পারছি, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ারসময় প্রথমবারের মতো কক্সবাজারের সাগর দেখি আমি। বাবার সঙ্গে বৃত্তি পরীক্ষাতে অংশ নিতে গিয়ে সাগর দেখতে যাই। এর আগেও হয়তো দেখে থাকতে পারি। কিন্তু মনে পড়ে না।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় আবার বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য চকরিয়ার নিজ বাড়ি থেকে কক্সবাজার যাই। মধ্যখানে আরও সৈকতে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, অষ্টম শ্রেণীরটা তাৎপর্যপূর্ণ। ওইবার অভিভাবকবিহীন সেখানে যাই। পড়াশুনা মাথায় তুলে সমুদ্রের নীল জলরাশিতে ইচ্ছে মতো দাপাদাপি করছিলাম। মনে হচ্ছিল সমুদ্রে আকাশ দেখা যায়। কারণ, পানি এতো স্বচ্ছ আর নীল।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রতিমাসে কক্সবাজার যাওয়া হতো। ওই সময় রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম। ফলে উদ্দেশ্যও ছিল রাজনৈতিক। ওই সময় কোনো কোনো রাত সৈকতেও কাটিয়ে দিতাম। সে এক অনাবিল আনন্দের অভিজ্ঞতা।
একই সময় মানে আমাদের কৌশোরে আরও এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চাল ছিল। বাইসাইকেল নিয়ে বনবাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ানো। কখনও চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী বনাঞ্চল, আবার কখনও লামার গহীন অরণ্যে। আমাদেরশৈশব আর কৈশোরের একটা বড় অংশ ছিল প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে।
কিন্তু কক্সবাজারের ওই প্রকৃতির ওপর আঘাত শুরু হয় ১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে। ওই সময় থেকে গাছ কেটে বন উজার শুরু হয়। মূলত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ওই যাত্রা শুরু হয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলব বিভাগের অসাধু কর্মীরা। ২০০১ সালের মধ্যে গোটা কক্সবাজার আর বান্দরবনের লামা-আলীকদমের ৯০ শতাংশ বন উজাড় হয়ে যায়।
আর কক্সবাজার সৈকতে উন্নয়নের নামে ব্যাপক আকারে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় ২০০১-০২ সাল থেকে। নির্মিত হতে থাকে অসংখ্য হোটেল-মোটেল। সাফ করে ফেলা হয় ঝাউবন। হোটেল-মোটেলের ব্যবসার মুনাফার জন্য সৈকতের সৌন্দর্য নিয়ে শুরু হয় বিজ্ঞাপন বন্যা। পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে আকর্ষণীয়ভাবে।
কিন্তু উন্নয়নের জোয়ারে হারিয়ে যায় প্রাকৃতির আদরে গড়া সৈকতের সৌন্দর্য। নীল স্বচ্ছ পানি এখন সেখানে আর দেখা যায় না। কারণ, পানিতে ময়লা। শহরের বর্জ্য গিয়ে পড়ছে সমুদ্রে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। মুক্তভাবে প্রকৃতির স্বাদ নেওয়ার জন্য জায়গাও কমে আসছে।
অবকাঠামো নির্মাণ করাহলেই উন্নয়ন হয় না। প্রকৃতিকে চর্চা করাও উন্নয়ন। এর জন্য বুদ্ধি আর কৌশল প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়োজন হয় মনের উন্নয়ন। প্রকৃতি বাদ দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না।
গত তিনমাস ধরে আমি যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের স্প্রিংফিল্ডে থাকি। এখানে বড় কোনো নদী আমার চোখে পড়েনি। একদিন ভোরে হাঁটতে গিয়ে খেয়াল করি, দুইপাশে পাথরের দীর্ঘ কৃত্রিম বড় দেয়াল। মাঝখানে শুকনো প্রবাহ। পানি নেই। কিন্তু বুঝা যাচ্ছে, এখানে পানির প্রবাহ ছিল। পাশের সাইনবোর্ডে পড়ে দেখলাম, এটি একটি নদী। এখানেনামা নিষেধ। বর্ষাখালে এখানে নদীর প্রবাহটি সক্রিয় হয়ে উঠে। অথচ, আমার দেশে এরকম অসংখ্য নদীকে দখল করে আমরা হত্যা করছি। আমরা হত্যা করছি প্রতিনিয়ত আমাদের সাগরকে, বনকে এবং গোটা প্রকৃতিকে। প্রকৃতিকে হত্যার এই যজ্ঞ এখনই থামাতে হবে।
রেললাইন হয়েছে। রেলস্টেশন হয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর হয়েছে। এরসবকয়টি খুবই জরূরি। কিন্তু, একই সঙ্গে কক্সবাজারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছেসাইক্লোনের ক্ষয়ক্ষতি। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ক্ষেত্রবিশেষে আমাদেরকিছু কিছু উন্নয়নের প্রতিপাঠ করা উচিৎ। উন্নয়ন অবশ্যই দরকার।অবকাঠামো নির্মাণেরও বিকল্প নেই। কিন্তু তা হতে হবে প্রকৃতিবান্ধব।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি স্টেট ইউনিভার্সটিতে অধ্যায়নরত